বগুড়ায় গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে বিএনপি ও জামায়াত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা শত শত মামলার মধ্যে ৪৫০টি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছে। এসব আবেদন স্থানীয় জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে ২৫০টি মামলাকে প্রত্যাহারযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করে মতামত পাঠানো হয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। ফেব্রুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো সম্ভব হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য একটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর জারি করা নীতিমালায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের মধ্যে দায়ের হওয়া মামলাগুলো যাচাই-বাছাই করে প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করতে হবে। যেসব মামলা রাজনৈতিক বা হয়রানিমূলক প্রমাণিত হবে, সেগুলো প্রত্যাহারের জন্য সুপারিশ করা হবে।
জেলা পর্যায়ে গঠিত চার সদস্যের কমিটি মামলাগুলোর যাচাই-বাছাই করছে। এই কমিটির সভাপতি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং সদস্য সচিব অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। বাকি দুই সদস্য হলেন সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপার এবং পাবলিক প্রসিকিউটর। প্রাথমিকভাবে আবেদনগুলো পাবলিক প্রসিকিউটরের কাছে পাঠানো হয়, যিনি ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে মতামত দেন। এরপর জেলা কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে চূড়ান্ত তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
বগুড়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আলী আজগর হেনা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে তার বিরুদ্ধে মোট ৩৫টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ২টির বিচার ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। বাকি ৩৩টি মামলা বিচারাধীন। তিনি জানান, এসব মামলার মধ্যে ১৭টি শুধুমাত্র ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি নির্বাচন প্রতিহত করার আন্দোলনের সময় দায়ের করা হয়। এসব মামলাকে হয়রানিমূলক উল্লেখ করে তিনি প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করেছেন।
বগুড়া জেলা বিএনপির সভাপতি রেজাউল করিম বাদশা তার বিরুদ্ধে চলমান ১৬টি মামলার কথা উল্লেখ করে বলেন, শুধু আওয়ামী লীগের শাসনামলেই নয়, ওয়ান ইলেভেনের সময়েও বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেন, ২০০৭-২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের সময় দায়ের করা মামলাগুলোও প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী যুবদল বগুড়া শহর শাখার সাবেক সভাপতি মাসুদ রানা জানান, তার বিরুদ্ধে ১২৩টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ৩৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে এবং ৮৭টি বিচারাধীন রয়েছে। তিনি বলেন, “আমার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো দেওয়া হয়েছে, তা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। আমি আশা করছি, ইনসাফ পাব।”
জামায়াতে ইসলামী বগুড়া শহর শাখার নায়েবে আমীর মাওলানা আলমগীর হোসেন বলেন, জামায়াত ও ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে প্রায় ২৫০টি মামলা দেওয়া হয়েছিল। কিছু মামলায় ১০০ থেকে ১৫০ জন পর্যন্ত আসামি করা হয়েছে। এসব মামলাকে হয়রানিমূলক উল্লেখ করে তিনিও প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন।
বগুড়ার পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট আব্দুল বাছেদ জানান, আওয়ামী লীগের শাসনামলে রাজনৈতিক কারণে অন্তত সাড়ে ৭০০ মামলা দায়ের করা হয়েছিল। প্রতিটি মামলায় গড়ে ৪৫ জন করে আসামি করা হয়। এই হিসাবে প্রায় ৩৪ হাজার বিরোধী দলীয় নেতা-কর্মীকে এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে। ২০০৭-২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের সময় দায়ের করা মামলাগুলোও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। তবে সেই মামলাগুলো এখনো প্রত্যাহারের আওতায় আসেনি। বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, “নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সাড়ে ৪০০ মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জমা পড়েছে। যাচাই-বাছাই চলছে। আশা করছি, ফেব্রুয়ারির মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করা সম্ভব হবে।”
জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাবেক সভাপতি মাসুদ রানা তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে জানান, সরকারবিরোধী আন্দোলনে তার সক্রিয় অংশগ্রহণের জন্য তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। ২০১৫ সালের ২ মে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করার পর তার পায়ে গুলি করে। তিনি জানান, “এই ধরনের হয়রানিমূলক মামলা আমাকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।”
প্রত্যাহারের আবেদন করতে হলে সংশ্লিষ্ট মামলার এজাহার এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে চার্জশীটের সার্টিফাইড কপি জমা দিতে হয়। আবেদন পাওয়ার পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তা পিপির কাছে পাঠান, যিনি ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে মতামত প্রদান করেন। এরপর জেলা কমিটি তা যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়। যেসব মামলা হয়রানিমূলক হিসেবে প্রমাণিত হয়, সেগুলো চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
বগুড়ায় বিএনপি ও জামায়াত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে এ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে এটি বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। তবে ২০০৭-২০০৮ সালের সেনাসমর্থিত সরকারের সময় দায়েরকৃত মামলাগুলো নিয়ে এখনও কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না হওয়ায় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।