কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার নাওডাঙ্গা ইউনিয়নের পশ্চিম বালাটারী গ্রামের ৬০ বছর বয়সী তাহমিনা আক্তার জীবন সংগ্রামের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। স্বামী হারানোর পর যখন জীবনের প্রতিকূলতা তার ওপর চেপে বসেছিল, তখনও তিনি দমে যাননি। নিজের আত্মপ্রত্যয়, কঠোর পরিশ্রম ও সাহসিকতায় তিনি জীবনের সব বাঁধা অতিক্রম করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। তার এই সংগ্রামের গল্প শুধু একটি গ্রামের নয়, বরং এটি সারাদেশের জন্য অনুপ্রেরণার প্রতীক।
তাহমিনা আক্তারের জীবন বদলে যায় বারো বছর আগে, যখন স্বামী আকস্মিকভাবে মারা যান। দুই সন্তান থাকলেও তারা কোনো সহায়তার হাত বাড়ায়নি। একদিকে স্বামীর শূন্যতা, অন্যদিকে সন্তানদের থেকে বিচ্ছিন্নতা—সব মিলিয়ে তাহমিনার জীবন হয়ে ওঠে চ্যালেঞ্জের পাহাড়। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। স্বামীর রেখে যাওয়া দেড় একর জমিকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করে নিজের জীবিকার জন্য মরিচসহ বিভিন্ন সবজি চাষ শুরু করেন।
তিনি জানান, “প্রথমদিকে বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে বাঁচব। তবে একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি নিজে কিছু করব। শুরুতে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে—কখনো অর্থের অভাব, কখনো সমাজের টিপ্পনী। কিন্তু আমি থামিনি।”
তাহমিনা তার জমিতে মরিচ, বেগুন, লাউসহ নানা ধরনের সবজি চাষ করেন। স্থানীয় বাজারে এসব ফসল বিক্রি করেই তিনি জীবিকা নির্বাহ করেন। তার পরিশ্রম ও একাগ্রতা তাকে আজ একজন সফল কৃষি উদ্যোক্তায় পরিণত করেছে।
তাহমিনার প্রতিবেশীরা জানান, তার এই সংগ্রামী মনোভাব দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন। তারা এখন নিজের জমিতে ফসল উৎপাদনে মনোযোগ দিচ্ছেন। এক প্রতিবেশী বলেন, “তাহমিনার মতো একজন নারী যদি এত প্রতিকূলতার মধ্যেও সফল হতে পারেন, তবে আমরা কেন পারব না? তিনি আমাদের জন্য এক উদাহরণ।”
তবে তাহমিনা আক্তারের আক্ষেপও আছে। তিনি বলেন, “সরকারি কোনো সহায়তা পাইনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে একটি স্প্রে মেশিনের জন্য আবেদন করেছিলাম, কিন্তু সেটি মঞ্জুর হয়নি। আমার মতো অসহায় নারী যদি সামান্য একটি স্প্রে মেশিন না পায়, তাহলে কোটি কোটি টাকার সরকারি সহায়তা কোথায় যাচ্ছে?”
সরকারি সহায়তার অভাবে হতাশ হলেও তাহমিনা আক্তার নিজেকে থামাননি। তার জীবন দেখিয়ে দেয় যে ইচ্ছাশক্তি আর পরিশ্রম দিয়ে জীবনের যে কোনো কঠিন সময়কে জয় করা সম্ভব।
তাহমিনার জীবন কেবল তার নিজের নয়, এটি সমাজের জন্য এক শক্তিশালী বার্তা। তার এই অদম্য সংগ্রাম প্রমাণ করে, নারী তার প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজের ভাগ্য নিজেই গড়ে নিতে পারে। এ গল্প সমাজের প্রতিটি নারীর জন্য এক অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে।
তাহমিনা আক্তারের সংগ্রামী জীবনের গল্প কেবল গ্রাম কিংবা জেলা নয়, বরং পুরো দেশের নারীদের মনে সাহস যোগাবে। তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সাহস ও অদম্য মনোবল থাকলে জীবনের কোনো বাধাই আপনাকে থামাতে পারবে না।