Homeআইন বিচারচ্যালেঞ্জের মুখে আইন-শৃঙ্খলা, খুন-ডাকাতি-ছিনতাই বাড়াচ্ছে উদ্বেগ

চ্যালেঞ্জের মুখে আইন-শৃঙ্খলা, খুন-ডাকাতি-ছিনতাই বাড়াচ্ছে উদ্বেগ

শুরু থেকে এ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষসহ অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা। কারণ ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অনুপস্থিতি এবং পরবর্তী সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে শিথিলতার সুযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে খুন-রাহাজানি, ডাকাতি-ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে।
উদ্বেগ বাড়াচ্ছে খুন ডাকাতি ছিনতাইএদিকে গত জুলাই-আগস্ট মাসে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল দেশে। আন্দোলন দমানোর জন্য ৫ আগস্ট পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অতিরিক্ত বল প্রয়োগের কারণে নিহতের সংখ্যা বাড়তি ছিল।

কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে খুনের ঘটনা অন্যান্য বছরের তুলনায় বেড়েছে।
পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সারা দেশে খুনের শিকার হয়েছে ২৮৩ জন, অক্টোবর মাসে ২৪৯ জন এবং নভেম্বরে ২১১ জন। ২০২৩ সালের এই তিন মাসে খুনের ঘটনা আরো কম ছিল। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খুন হয়েছিল ২৩৮ জন, অক্টোবর মাসে ২৫৮ জন এবং নভেম্বর মাসে ২২৭ জন।


আরও পড়ুন:লক্ষ্মীপুরে অবৈধ ২ জুস ফ্যাক্টরি সিলগালা ভ্রাম্যমান আদালতের, মালামাল জব্দ


গত সপ্তাহে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে খুলনার স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ও সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপুকে গুলি করে হত্যা, নেত্রকোনার দুর্গাপুরে ছুটিতে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া পুলিশের এসআই শফিকুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা, জাজিরা থানা থেকে ওসি আল-আমিনের ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার এবং মুন্সীগঞ্জে থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে নতুন করে উদ্বেগ ও আতঙ্ক বাড়াচ্ছে।

নিহত এসআই শফিকুলের স্ত্রী স্কুল শিক্ষক রাবেয়া আক্তার বলেন, ‘কারা আমার স্বামীকে হত্যা করল আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।’ আর নেত্রকোনা জেলার বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) মো. লুত্ফর রহমান বলেন, ‘ধারণা করা হচ্ছে, ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা হয়েছে।

জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।’
এদিকে মুন্সীগঞ্জে আটকের পর থানা থেকে মামলার এজাহারভুক্ত আসামি তরিকুল নামের এক যুবদল নেতাকে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশের ভাষ্য, তাঁকে ছাড়াতে যুবদল নেতাদের চাপ পুলিশ মেনে না নিলে আসামি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

এর আগে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি ছিল বেশ আলোচিত। ওই এলাকায় প্রকাশ্যে ছিনতাই, বিহারি ক্যাম্পে খুনাখুনি, ডাকাতি, সশস্ত্র মহড়ার ঘটনা ঘটে।

সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী আগের মতো সক্রিয় থাকলে আসামি ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা সহজে ঘটার কথা না।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে তিন হাজার ২২৮টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে জুলাই-আগস্টে ঘটে সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড। আর ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে মামলা হয়েছে দুই হাজার ৭৯০টি।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগ রাজনৈতিক ও পারিবারিক প্রতিহিংসার কারণে ঘটছে। এর মধ্যে রয়েছে আদর্শগত মতপার্থক্য, পূর্ববিরোধ, দখলদারি, অপরাজনীতি। এ ছাড়া ছিনতাই কিংবা ডাকাতির ঘটনায়ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা ঘুরে না দাঁড়ানো পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, গত ৫ আগস্টের পর এক মাসের মতো পুলিশের অনুপস্থিতি অপরাধ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে টহল ও পুলিশিং চলছে। অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কমিটি পুলিশিং সেবাও বাড়ানো হচ্ছে।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সহিংসতা প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে কমিউনিটি পুলিশ ব্যবস্থা কার্যকর করার মাধ্যমে সামাজিকভাবে উদ্ভূত রাজনৈতিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।
উঠান বৈঠকের মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে আশ্বস্ত করা যেতে পারে, অন্যায়ভাবে কাউকে হয়রানি করা হবে না। এ ছাড়া মিথ্যা মামলা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা রুজু থেকে বিরত থাকতে হবে। তদন্তকাজে পক্ষপাতিত্ব থেকে দূরে থাকতে হবে। এভাবেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী সহিংসতা রোধে কাজ করতে পারে।’
সাম্প্রতিক আরো চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড
গত ১০ জানুয়ারি বিকেলে ফরিদপুর সদর উপজেলায় একটি ফিলিং স্টেশন থেকে তুলে নিয়ে ওবায়দুর রহমান খান (৩২) নামের এক যুবককে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই সময় ওই যুবকের চোখ উপড়ে ফেলা হয়। কোতোয়ালি থানার ওসি মো. আসাদউজ্জামান এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিহত ওবায়দুর রহমান খান উপজেলার কানাইপুর ইউনিয়নের ঝাউখোলা গ্রামের বিল্লাল খানের ছেলে।

এদিকে সূত্র মতে, যৌথ বাহিনীর বিশেষ অভিযানে গ্রেপ্তার, র‌্যাব-পুলিশের তৎপরতার মধ্যেও সারা দেশে প্রতিদিনই একাধিক ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনা ঘটছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট এক হাজার ৬৭২টি ডাকাতি ও দস্যুতার মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দস্যুতার মামলা হয়েছে এক হাজার ২৫৩টি এবং ডাকাতির মামলা হয়েছে ৪১৯টি।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চুরি-ছিনতাইসহ যেসব অপরাধের ঘটনা ঘটছে, প্রতিটি ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে অনেক অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। তবে অপরাধ কখনো বাড়ে, আবার কখনো কমে। পুলিশ সব সময় চেষ্টা করে অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে।’

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সভাপতি মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান—এ নীতিতে চলতে হবে সরকারকে। বর্তমানে যারা সহিংসতা করছে, তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং আগেও যারা রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন সহিংসতায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল, সবাইকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

সর্বশেষ খবর