Homeজেলা৪০ বছর পর ছুটি নিলেন শিক্ষক

৪০ বছর পর ছুটি নিলেন শিক্ষক

মা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত। পাঠদান শেষে টানা দেড় মাস মায়ের সেবা করেছেন। অবশেষে ১৯৯৩ সালের ৫ নভেম্বর তার মা সূর্য বানু মারা যান। সেদিন ছিল শুক্রবার।

দাফন সম্পন্ন করে পরদিন স্কুলে সময়মতো হাজির হয়ে পড়েন। ধুম জ্বরে কাতরানো সন্তান সম্ভাবা স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে স্কুলে এসে পাঠদান করেছেন। এভাবে এক এক করে পার হয়েছে প্রায় ৪০ বছর। মামা-মামি, ফুফা-ফুফু আর শ্বশুর-শাশুড়ির জানাজায় অংশ নেওয়া ছাড়া একদিনও স্কুল কামাই করেননি।

শনিবারেও একবার স্কুলে গিয়ে ঢুঁ মেরে আসতেন। এসব তার জীবনের টুকরো গল্প। এগুলো গল্প নয়, আসলে সত্যি।
এই তিনি হচ্ছেন মোশারেফ হোসেন হাওলাদার।

দুধলমৌ আশ্বেদ কাদের মেমোরিয়াল (একিউএম) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক পদে কর্মরত ছিলেন। বরিশালের বাকেরগঞ্জে তার দাদার প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলে ২৬ ডিসেম্বর শেষ কার্য দিবস ছিল এই শিক্ষকের। এই ৪০ বছর শিক্ষকতার জীবনে তার প্রাপ্য অন্তত ৮০০ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি। সেখান থেকে মাত্র কয়েকটি দিন ছুটি কাটিয়েছেন। তাও নিকট আত্মীয়ের মৃত্যুর মতো খুব বেশি জরুরি প্রয়োজনে।

পেশার প্রতি তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ সবাই। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে একাধিকবার ‘বর্ষসেরা উপস্থিত শিক্ষক’ হিসেবে সম্মানিত করেছিলেন।
যেভাবে শিক্ষকতায় হাতেখড়ি
উপজেলার ভরপাশা ইউনিয়নের দক্ষিণ দুধলমৌ গ্রামের বাসিন্দা কাদের হাওলাদার ও আশ্বেদ গাজী। সম্পর্কে তারা বেয়াই। তারাই ১৯৫৩ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। দুজনের নামেই বিদ্যালয়টি নামকরণ করা হয়। প্রতিষ্ঠার শুরুতেই কাদের হাওলাদারের ছেলে কাঞ্চন আলী হাওলাদার শিক্ষকতা করতেন। ১৯৮৪ সালে কাদের হাওলাদারের নাতি মোশারেফ হোসেন হাওলাদার স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে খণ্ডকালীন শিক্ষকতা শুরু করেন।

তার আগে দুধলমৌ এ কিউ এম মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, দুমকী কৃষি কলেজ থেকে এইচএসসি এবং পটুয়াখালী একেএম কলেজ থেকে স্নাতক (বিএ) পাস করেন। সেই থেকে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে ওই স্কুলে পাঠদান করেছেন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের ১ অক্টোবর দুধলমৌ এ কিউ এম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন মোশারেফ। দুই ছেলে আর এক মেয়ের জনক তিনি। তারা সবাই ওই বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন।

স্কুলই ছিল তার সংসার
৪০ বছরের চাকরিজীবনে হাসি-কান্নার অনেক ঘটনা ঘটে গেছে মোশারেফ হোসেনের জীবনে। কিন্তু এসব ঘটনা তাকে স্কুলে সময়মতো হাজির হওয়া থেকে বিরত রাখতে পারেনি। বাবা মারা গেছেন সেই ছোটবেলা। আর মা লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। বিষয়টি তারা মায়ের মৃত্যুর দেড় মাস আগে জানতে পারেন। পাঠদানের পাশাপাশি তখন মায়ের সেবা করেছেন। তিনি জানান, ১৯৯৩ সালের ৫ নভেম্বর রাতে তার মা সূর্য বানু মারা যান। সেদিন ছিল শুক্রবার। দাফন সম্পন্ন করে পরদিন স্কুলে সময়মতো হাজির হয়ে পড়েন।


আরও পড়ুন:সিলেটে বিশৃঙ্খলা এড়াতে ওয়াজ মাহফিলের অনুমতি দেয়নি প্রশাসন


মোশারেফ হোসেন আরো জানান, ২০০৩ সালের মাঝামাঝি সময় তার নাকে পলি ধরা পড়ে। প্রায় ৪ মাস যন্ত্রণায় ছটফট করেছেন। কিন্তু স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় যাননি। ওই বছরের শেষের দিকে স্কুল বন্ধ হলে তিনি ঢাকার বুশরা ক্লিনিকে গিয়ে নাকে অস্ত্রোপচার করান। ঢাকায় সেই ক্লিনিকে তাকে বেশ কয়েক দিন থাকতে হয়েছিল। ২০২১ সালে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, তখনো স্কুল ছুটি ছিল। স্কুল কামাই হবে ভেবে বন্ধের মধ্যে মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করেছেন।

মোশারেফ হোসেনের মেয়ে নুসরাত জাহানু কুসুম বলেন, ‘ছুটি নিয়ে বাবা কখনোই কোথাও বেড়াতে যেতেন না। এ নিয়ে আমাদের ছোট সময় আফসোস ছিল। এখন আর নেই। বাবা শুধু নিকট আত্মীয়-স্বজন মারা গেলে তাদের জানাজায় অংশ নিতে গিয়ে ছুটি নিতেন। প্রতিদিন সকালে স্কুলে যেতেন, পাঠদান শেষে আবার বাসায় ফিরতেন। বিকেলের দিকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিতেন। এই কাজটি রাত অবধি করতেন। শনিবারও স্কুলে যেতেন। এক কথায় স্কুল ছিল বাবার সংসার। বাবার এই কাজের জন্য আমরা গর্বিত।’

পেয়েছিলেন স্বীকৃতি
বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আল মামুন হাওলাদার। তিনি এই বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। মোশারেফ হোসেনের কাছে শিখেছেন। তিনি জানান, তাদের বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের পরিবারের উদ্যোগে ২০০০ সালে শিক্ষকদের জন্য ‘ক্যাজুয়াল লিভ (সিএল) বোনাস’ চালু হয়। যে শিক্ষক-কর্মচারী সারা বছরে এক দিনও অনুপস্থিত থাকবেন না, তাকে বোনাস দেওয়া হয়। সিএল বোনাস চালুর পর মোশারেফ হোসেন প্রতিবারও বোনাসটি পেয়েছেন। পাশাপাশি বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে একাধিকবার ‘বর্ষসেরা উপস্থিত শিক্ষক’ হিসেবে সম্মানিত করেছিলেন।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাদিয়া সুবর্না পিয়া জানান, তার ৪০ বছরের শিক্ষকতা জীবনে একটিও ছুটি নেননি। কখনো ক্লাসের সময় অনুপস্থিত হননি। কোনো ঝড়-বৃষ্টি কিংবা অসুস্থতা কখনোই তার দায়িত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেননি। যিনি তার জীবনের অমূল্য সময় শিক্ষার্থীদের জন্য উৎসর্গ করেছেন।

মোশারেফ হোসেনের জীবনের এসব ঘটনাকে ‘কিংবদন্তির মতো’ বলে মন্তব্য করে তিনি আরো জানান, এ ঘটনা শিক্ষার্থীদেরকে আপ্লুত করেছে। তার মতো নিয়মানুবর্তিতার দাবি অনেকেই করতে পারেন না। তাকে শ্রদ্ধা জানানোর শ্রেষ্ঠ উপায় হবে, এ মানুষটিকে অনুসরণ করা। তারই অংশ হিসেবে ২৮ ডিসেম্বর তাঁকে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা সংবর্ধনা দিয়েছেন।

দুধল‌মৌ মাধ‌্যমিক বিদ‌্যাল‌য়ের সা‌বেক প্রধান শিক্ষক হা‌বিবুর রহমান খান। বা‌কেরগঞ্জ জীবন সিংহ ইউনিয়ন (জে এস ইউ) মাধ‌্যমিক বিদ‌্যাল‌য়ের প্রধান শিক্ষক হি‌সে‌বে তি‌নি কর্মরত। হা‌বিবুর রহমান খান বলেন, ‘সরকারি বিধি অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষক বছরে ২০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি ভোগ করতে পারেন। তা ছাড়া নিজের প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা, অর্জিত ছুটিসহ বিভিন্ন প্রকার ছুটি ভোগ করার বিধানও আছে। কিন্তু মোশারেফ হোসেন এমন একজন শিক্ষক, যিনি ৪০ বছরে তার প্রাপ্য অন্তত ৪০০ দিনের নৈমিত্তিক ছুটি থেকে মাত্র কয়েকটি দিন কাটিয়েছেন। তাও নিকট আত্মীয়-স্বজনদের জানাজায় অংশ নেওয়ার জন্য। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৮ বছর ধরে তাকে ‘বর্ষসেরা উপস্থিত শিক্ষক’ হিসেবে সম্মানিত করেছে। তার (মান্নান) অবসরের পর সেটি বন্ধ রয়েছেন।’

ছুটি কেন নেননি জানতে চাইলে একগাল হাসি দিয়ে মোশারেফ হোসেন বলেন, ‘স্কুলে না গেলে মনে হয় দিনটা বুঝি শেষ হবে না। ক্লাসে শিক্ষক না থাকলে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হয়। তা ছাড়া একজন শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলে অন্যদের ওপর চাপ পড়ে। শিক্ষার্থীরা পাঠদান থেকে বঞ্চিত হয়। তাই ছুটি নেওয়ার বিষয়টি বেমালুম ভুলে যাই। আমি বিশ্বাস করি, নিজ অবস্থান থেকে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও ভালোবাসা পেলে শিক্ষার্থীরা অনেক দূর এগিয়ে যাবে।’

সর্বশেষ খবর