মানুষের কৌতূহল সবসময় নতুন প্রশ্নের জন্ম দেয়। চলন্ত ট্রেনে ড্রোন উড়ানো এমনই একটি বিষয় যা বৈজ্ঞানিকভাবে চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন ফেলে। একটি ট্রেন ১০০ কিমি/ঘণ্টা বেগে চললে এবং সেই ট্রেনের ভিতরে ড্রোন উড়ানো হয়, তখন ড্রোনটি কীভাবে ট্রেনের বেগের সাথে মানিয়ে চলে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের নিউটনের গতিসূত্র এবং আপেক্ষিক গতির ধারণাগুলি বুঝতে হবে।
প্রথমে বুঝে নিতে হবে আপেক্ষিক গতির ধারণা। যখন আমরা একটি গাড়ি বা ট্রেনে ভ্রমণ করি, আমাদের আশপাশের পরিবেশও আমাদের সঙ্গে একই গতিতে চলতে থাকে। একটি ট্রেন ১০০ কিমি/ঘণ্টা বেগে চলার সময়, সেই ট্রেনের ভিতরে থাকা যেকোনো বস্তু, যাত্রী বা এমনকি ড্রোনও, একই বেগে চলমান থাকে। তবে এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই গতি ট্রেনের ভিতরের পরিবেশে আপেক্ষিক, যা ট্রেনের বাহিরের পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
ধরা যাক, ট্রেনের মধ্যে একটি ড্রোন উড়ানো হলো। ড্রোনটি তখন ট্রেনের ভিতরের বাতাসের গতি এবং চাপ অনুযায়ী কাজ করে। ট্রেনের ভিতরে থাকা বাতাসও একই গতিতে চলছে, তাই ড্রোনটির জন্য ট্রেনের বেগের সাথে মানিয়ে চলা সহজ হয়ে যায়। এটি বোঝার জন্য একটি সাধারণ উদাহরণ হলো: যখন আমরা একটি চলন্ত ট্রেনের মধ্যে লাফ দেই, তখন আমরা ট্রেনের পিছনে পড়ে যাই না। এর কারণ হলো, আমাদের শরীর ইতোমধ্যেই ট্রেনের গতির সাথে সমানুপাতিক গতিতে চলমান থাকে। একইভাবে, ড্রোনটিও এই আপেক্ষিক গতির নিয়ম মেনে চলে।
ড্রোন উড়তে পারে কারণ এটি এর প্রপেলার থেকে বাতাসের সাথে মিথস্ক্রিয়া ঘটিয়ে ভাসমান থাকে। চলন্ত ট্রেনের ভিতরে, ড্রোনটি সেই পরিবেশে উড়ে যা ইতোমধ্যেই ১০০ কিমি/ঘণ্টা গতিতে চলমান। এখানে বাহ্যিক বায়ুর গতি বা চাপের কোনো প্রভাব পড়ে না, কারণ ট্রেনের ভিতরের বাতাস আলাদা একটি সিস্টেম তৈরি করে। সুতরাং ড্রোনটির জন্য এটি একই রকম সহজ হয়, যেমন এটি স্থির একটি ঘরের মধ্যে উড়ে।
এই পুরো প্রক্রিয়াটি বোঝার জন্য নিউটনের প্রথম এবং দ্বিতীয় গতিসূত্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিউটনের প্রথম সূত্র বলে যে, যদি কোনো বস্তুতে বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ না করা হয়, তবে সেটি তার স্থির অবস্থা বা সরলরেখায় একসমান গতিতে চলমান অবস্থা বজায় রাখে। ট্রেনের মধ্যে ড্রোনটি এক ধরনের বন্ধ সিস্টেমের মধ্যে কাজ করে। এখানে বাহ্যিক কোনো বল প্রয়োগ হয় না যা ড্রোনটির গতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
নিউটনের দ্বিতীয় সূত্র বলে যে, কোনো বস্তুর উপর প্রয়োগ করা বল তার ভর এবং ত্বরণের গুণফলের সমান। ড্রোনটি তার প্রপেলার দ্বারা যে শক্তি উৎপন্ন করে, তা ট্রেনের ভিতরের বাতাসের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে উড্ডয়ন নিশ্চিত করে। যেহেতু ট্রেনের ভিতরের বাতাসও ট্রেনের সাথে একই গতিতে চলমান, তাই ড্রোনটি সহজেই তার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ইনার্শিয়ার ধারণা। ইনার্শিয়া বা জড়তা হলো বস্তুটির সেই প্রবণতা, যার ফলে এটি তার গতির অবস্থা বজায় রাখে যতক্ষণ না বাহ্যিক কোনো বল এটি পরিবর্তন করে। চলন্ত ট্রেনের ভিতরে ড্রোনটি তার গতির অবস্থা বজায় রাখে কারণ এটি একই গতিতে চলমান ট্রেনের ভিতরে রয়েছে। ড্রোনটি যদি ট্রেনের বাইরে উড়ত, তবে বাহ্যিক বাতাসের গতি এবং চাপের কারণে এটি স্থিতিশীল থাকতে পারত না।
তাহলে প্রশ্ন আসে, ট্রেনটি যদি হঠাৎ থেমে যায় বা ত্বরান্বিত হয়, তখন কী হবে? এই ক্ষেত্রে ড্রোনটির গতির উপর প্রভাব পড়বে। যদি ট্রেনটি হঠাৎ থেমে যায়, তবে ট্রেনের ভিতরের বাতাসের গতি কমে যাবে এবং ড্রোনটি তার ভারসাম্য হারাতে পারে। একইভাবে, যদি ট্রেনটি ত্বরান্বিত হয়, তবে ড্রোনটির প্রপেলারকে অতিরিক্ত চাপ নিতে হবে, যাতে এটি তার অবস্থান ধরে রাখতে পারে। এই পরিবর্তনগুলি আপেক্ষিক গতির নিয়ম অনুযায়ী ঘটে।
এই ঘটনাটি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক উদাহরণের সাথেই সম্পর্কিত। উদাহরণস্বরূপ, বিমানের ভিতরে আমরা সাধারণত কোনো গতির অনুভূতি টের পাই না, যতক্ষণ না বিমানটি হঠাৎ গতিপথ পরিবর্তন করে। বিমানের ভিতরের যেকোনো বস্তু বিমানের আপেক্ষিক গতিতে চলমান থাকে। চলন্ত ট্রেনে ড্রোন উড়ানোর ঘটনাটি এই একই নীতির উপর ভিত্তি করে।
ড্রোন উড়ানোর এই প্রক্রিয়া আমাদের শিখায় যে, আপেক্ষিক গতির ধারণা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এটি বিজ্ঞানের একটি অন্যতম চমৎকার উদাহরণ, যেখানে নিউটনের গতিসূত্র এবং জড়তার ধারণা বাস্তব জীবনের পরিস্থিতির সাথে মিলে যায়। চলন্ত ট্রেনে ড্রোন উড়ানোর বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে জটিল মনে হলেও, এটি বিজ্ঞান এবং প্রকৃতির নিয়মের একটি সহজ প্রয়োগ।