লক্ষ্মীপুরের রায়পুর ও রামগঞ্জ উপজেলায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিএনপির বিবাদমান দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে আজ শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে উপজেলার উত্তর চরবংশী ইউনিয়নের খাসেরহাট ও বাবুরহাট এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
রামগঞ্জ উপজেলার ভাটরা ইউনিয়নে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। আহত হয়েছেন দুজনসহ অন্তত পাঁচজন। বুধবার সন্ধ্যায় ইউনিয়ন পরিষদের সামনে এ ঘটনা ঘটে। আহতরা হলেন, মিয়া বাড়ির রুবেল ও দিদার বাড়ির পলাশ খান। রুবেলকে উন্নত চিকিৎসার জন্য লক্ষ্মীপুর সরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। খবর পেয়ে রামগঞ্জ থানার পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গত সোমবার হীরাপুর গ্রামের রিয়াদ ও গুস্তারপাড়া গ্রামের মামুনের সঙ্গে ঝগড়া হয়। এর ভিত্তিতে মঙ্গলবার ইউনিয়ন পরিষদের পাশে সালিশ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সালিশি বৈঠকের একপর্যায়ে স্থানীয় চেয়ারম্যান দুজনের মধ্যে তর্ক হলে সালিশ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন বুধবার বিকেলে বিএনপি নেতা আবুল কাশেম ভাটরা বাজারে গেলে নেতাকর্মীরা দলীয় স্লোগান দেন। পরে বাজারের পাশের তফাদার বাড়ির ইকবাল তফাদারের সঙ্গে আগতদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হলে উভয়ের মধ্যে হাতাহাতি হয়। পরে রামগঞ্জ থানার পুলিশ ও সেনাবাহিনী ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েকদিন ধরে ভাটরা বাজারে বিএনপি নেতা এজিএস আবুল কাশেম ও ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি আবু হান্নান লাবলুর লোকজন ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে ছোটখাটো সমস্যাও হচ্ছে। গত বুধবার রাতে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। বাজারে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে যেকোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর আধিপত্য বন্ধের আহ্বান জানান ব্যবসায়ীরা।
বাজারের ব্যবসায়ী ডাক্তার আবদুল্লাহ বলেন, কয়েকদিন ধরে বাজারে তাদের নেতাকর্মীদের আনাগোনা দেখছি। বুধবার সন্ধ্যায় উভয় পক্ষের বাসিন্দাদের ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে বলা হয়। তারা না শুনেই ঝামেলায় পড়ে যায়। একপর্যায়ে পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। পরে রাতে বাজারে হট্টগোলের সময় আহত রুবেলের কাছ থেকে উদ্ধার করা ছুরিটি সেনাবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করে স্থানীয়রা। এ ঘটনায় কাউকে আটক বা অবরুদ্ধ করা হয়নি। তবে পরিস্থিতি শান্ত করতে আবুল কাশেম, শরীফ শাকিল, শাহাদাত সিকদারকে সরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ।
ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আবু সুফিয়ান ভূঁইয়া জানান, ভাটরা বাজারে ইউনিয়ন পরিষদ, ভূমি অফিসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থাকায় মানুষের আনাগোনা বেশি দেখা যায়। তবে তাই বলে স্থানীয়রা পেশীশক্তি ব্যবহার করে অন্যদের উপর হামলা করবে। আমি মনে করি বিএনপি এই উশৃঙ্খল মনোভাব পোষণ করেনা।
উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক এজিএস আবুল কাশেম বলেন, প্রতিদিনের মতো চা খেতে ভাটারা বাজারে গিয়েছিলাম। পরে স্থানীয় নেতাকর্মীরা সেখানে জড়ো হয়। কিন্তু আমাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না। তফাদার বাড়ির ইকবাল খামাখা পোলাপানের সাথে ঝামেলায় পড়ে। আমার কোনো গ্রুপ ছিল না, আমি বিএনপি করি কোনো গ্রুপকে বিশ্বাস করি না।
ইউনিয়ন বিএনপির সহ-সভাপতি আবু হান্নান লাভলু বলেন, গতকালের ঘটনায় আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। বিয়ের দাওয়াতে পাশের থানায় ছিলাম। একটি শ্রেণী একটি ব্যক্তিগত বিষয়কে দলীয় বিষয়ে পরিণত করছে। এখানে দলীয় কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমরাও কোনো গ্রুপ ছিল না।
ভাটরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ শামছুল আলম বুলবুল জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দুটি ছেলের মারামারির বিষয় সালিশি সিদ্ধান্তে সমাধান করা হয়। বুধবার সন্ধ্যার ঝামেলায় আমি অবগত নই।
উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব ভিপি বাহার জানান, ভাটরা ইউনিয়নে বিএনপির কোনো গ্রুপ নেই। তবে দলের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থা স্পষ্ট। যারা বিশৃঙ্খলা করবে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
রামগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি আবুল বাশার জানান, খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এই ঘটনায় এখনো কোনো পক্ষ অভিযোগ করেনি। আমাদের তদন্ত চলমান।
দফায় দফায় সংঘর্ষ, বাড়ি ঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও মারধরের ঘটনায় এখন পর্যন্তত উভয় পক্ষের অন্তত: ১৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে গুরুতর জখম শফিক রাঢ়ি (৪৮) ও লিন রাঢ়ি (৪৫) কে ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আহত তাহমিনা বেগম, সানু বেগম, গণি রাঢ়ি, মিজান খাঁন, কবির হোসেন, বিল্লাল হোসেন ও জিহাদকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখনো সেখানে উত্তেজনা বিরাজ করছে। আবারো যেকোন সময় উভয়পক্ষ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িত হওয়ার আশংকায় সাধারণ লোকজনের মাঝে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
এদিকে রায়পুর উপজেলার ২ নং উত্তরচর বংশী ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানায়, ৫ আগস্টের পর মেঘনার চর, মাছঘাট, বাজার, কাঁচামালের আড়ত নিয়ে উত্তর চরবংশী ইউনিয়ন বিএনপির মধ্যে দুটি ধারা সৃষ্টি হয়। একটি পক্ষের নেতৃত্ব দেন উপজেলা কৃষকদলের সদস্য সচিব শামিম গাজী ও অপরপক্ষে নেতৃত্ব দেন ইউনিয়ন বিএনপি নেতা ফারুক কবিরাজ। এলাকায় দলীয় প্রভাব বিস্তার নিয়েই মূলত: তাদের মধ্যে অন্ত:কোন্দলের সৃষ্টি হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বৃহস্পতিবার সকালে মেঘনার পাড়ের চান্দারখালের এলাকায় উপজেলা কৃষকদলের সদস্য সচিবের টেবিলের পাশের ব্যানার ছিড়ে ফেলেন খাসেরহাট এলাকার বিএনপির কর্মী ফারুক গাজি। এ নিয়ে শামিম গাজির নেতৃত্বে তাঁর অনুসারীরা খাসেরহাট বাজারে ইউনিয়ন বিএনপির কার্যালয়ে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এরপর ফারুক কবিরাজের নির্দেশে শামিম গাজীর অফিস ভাংচুর করা হয়। শুক্রবার সকালে বুল ও কবির হোসেনের নেতৃত্বে শামিমের শশুর শফিক রাঢ়ির বাড়িতে হামলা হয়। ওই সময় তারা শফিক রাঢ়িকে মারধর করে বাড়িঘর ভাংচুর, মিজানের বাড়ি ও দোকানে হামলা, দুটি মোটরসাইকেলে অগ্নি সংযোগ ও লুটপাট চালায়।
উপজেলা কৃষকদলের সদস্য সচিব শামিম গাজী বলেন, ফারুক কবিরাজের নির্দেশে আমাদের ওপর জঘন্য হামলা, ভাংচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। তিনি ঢাকা থেকে এলাকায় আসলেই নানান অঘটনের সৃষ্টি করেন।
ইউনিয়ন বিএনপি নেতা ফারুক কবিরাজ বলেন, ব্যানার নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় আমি মিমাংসা করে দেওয়ার আশ্বাস দেই। কিন্তু তারা না মেনে আমার নামে বাজারে অশালীন বক্তব্য দিয়ে মহড়া দিয়ে আমাদের অফিস ভাংচুর করা হয়। এরপর আমরাও তাদের উপর আক্রমন করি।
রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নিজাম উদ্দিন ভুঁইয়া বলেন, ঘটনাস্থলে সেনা সদস্যদের সাথে আমাদের পুলিশ পাঠিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। তদন্ত সাপেে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ঘটনায় একজনকে আটক করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোন প থেকে মামলা হয়নি।
বিএনপির দুই উপজেলায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের ঘটনায় লক্ষ্মীপুর জেলা বিএনপির আহবায়ক শহিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল। সংশ্লিষ্ট উপজেলার ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে বিষয়গুলি দেখে সমাধান করার ও প্রয়োজনে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।