Homeআন্তর্জাতিকমমি খাওয়ার ইতিহাস: ইউরোপের অদ্ভুত প্রথা

মমি খাওয়ার ইতিহাস: ইউরোপের অদ্ভুত প্রথা

১৮শ এবং ১৯শ শতাব্দীতে ইউরোপে একটি অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর রীতি ছিল—মমি খাওয়া। আরবি এবং ফরাসি চিকিৎসাবিদদের লেখা বইগুলির মাধ্যমে ইউরোপীয়রা শিখেছিল যে, মমি খাওয়া বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। এভাবে মমি খাওয়ার ধারণাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এবং এতে একটি রহস্যময় গোপন ক্ষমতা ও চিকিৎসা শক্তি থাকার বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল।

মিসরীয় মমি ইউরোপে প্রথম পৌঁছায় ১৭শ শতাব্দীতে। তখন ইউরোপে প্রচলিত ছিল নানা ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি, যার মধ্যে একাধিক প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহারের প্রতি আগ্রহ ছিল। তবে মমি বা মমিয়া (যা মমি থেকে তৈরি একটি ওষুধ) শুধু চিকিৎসা উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা হতো না, এটি ছিল রুচিকর একটি ভেষজ পদার্থ হিসেবে। এটি বেশিরভাগ সময় রোগীদের স্বাস্থ্য ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যবহৃত হতো, এমনকি অনেকে বিশ্বাস করতো যে, এটি অমরত্বের উপায়।

এ সময়ে চিকিৎসকদের ধারণা ছিল, মমির মধ্যে মিশে থাকা রাসায়নিক উপাদান এবং প্রাকৃতিক উপাদানগুলো শরীরে নতুন জীবন সঞ্চারিত করতে সাহায্য করবে। মমি খাওয়া এমনকি কখনো কখনো জীবনদায়ী হয়ে উঠত বলে মনে করা হতো, বিশেষ করে মহামারি বা শারীরিক দুর্বলতা কাটানোর জন্য। তবে এই বিশ্বাসের মূল ভিত্তি ছিল সম্পূর্ণভাবেই কুসংস্কার, যা সময়ের সঙ্গে সাথে মানুষের অন্ধ বিশ্বাসের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়ায়।

একটি বড় রকমের উন্মাদনা শুরু হয় ১৮শ শতাব্দীতে। তখন বিভিন্ন দোকানে মমি বিক্রি হতে শুরু করে। মিশরীয় মমির টুকরো, বিশেষ করে মস্তিষ্ক ও শরীরের অন্যান্য অংশ, খরচের অংক ছিল অত্যধিক। যদিও এগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল ছিল, তবুও মানুষ তা কিনতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে ভিক্টোরিয়ান যুগে মমি খাওয়ার ব্যাপারে ছিল অদ্ভুত এক জনপ্রিয়তা। মমি খাওয়ার জন্য এক ধরনের “মুমিয়া” নামে প্রস্তুত একটি মিশ্রণ তৈরি করা হতো যা শরীরের নানা সমস্যার সমাধান হিসেবে বিক্রি করা হতো।

যদিও এসব ক্ষেত্রে কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল না, তবুও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মমির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়তে থাকে। মমি খাওয়ার এই রীতি একসময় পশ্চিম ইউরোপের উচ্চবিত্তদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি একে জীবনের অমরত্ব লাভের একটি উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কেউ কেউ দাবি করতেন, মমি খাওয়ার মাধ্যমে তারা অতীতের সময়ের স্মৃতি ও শক্তি লাভ করতে সক্ষম হচ্ছিলেন।

এ সময়ের মধ্যে ইউরোপীয়রা একে মিশরের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের অংশ হিসেবে দেখতো। মমি খাওয়ার একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল—এটি কেবলমাত্র চিকিৎসার উদ্দেশ্যে নয়, বরং মিশরীয় সভ্যতার প্রতি শ্রদ্ধাও জানানো হতো। এটি ছিল এক ধরনের সৌন্দর্যবোধ এবং রহস্যের প্রতি আকর্ষণ।

কিন্তু যেহেতু এই রীতি অবশেষে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে অপ্রমাণিত হয়ে পড়েছিল, তাই ১৯শ শতাব্দীর শেষে মমি খাওয়ার প্রচলন ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। মমি খাওয়ার চাহিদা কমে গিয়ে, অধিকাংশ চিকিৎসকই মমি ব্যবহারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন। তবুও, ইতিহাসের এক অদ্ভুত অধ্যায় হিসেবে মমি খাওয়ার বিষয়টি আজও মানুষের কল্পনায় বেঁচে থাকে।

আজকের দিনে, মমি খাওয়ার প্রথা একটি বিরল এবং অবিশ্বাস্য কুসংস্কারের নিদর্শন হিসেবে দেখা হয়। তবে এই বিষয়টি ইউরোপীয় ইতিহাসের একটি অদ্ভুত অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে, যা আমাদের জানায় যে, বিজ্ঞান না থাকলে মানুষ কত সহজেই অজানা ও অপ্রমাণিত বিশ্বাসে আটকে থাকতে পারে।

সর্বশেষ খবর