বিদ্রোহীদের মাত্র ১২ দিনের অগ্রাভিযানের মুখে বাশার আল আসাদের অবিশ্বাস্য পরাজয় বিস্মিত করেছে আন্তর্জাতিক সব মহলকে। সরকারবিরোধী বিদ্রোহীরা রোববার (৮ ডিসেম্বর) রাজধানী দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ নিলে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় উড়াল দেন।
সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের শাসন শুরু হয়েছিল সত্তরের দশকের শুরু থেকে। বাবার পর গত ২৪ বছর ধরে সিরিয়া শাসন করছিলেন আসাদ। তিনি ছিলেন ইরান ও রাশিয়ার কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।
দীর্ঘদিনের আসাদ শাসনের পতনের পেছনে ছিলেন হায়াত তাহরির আল-শামের (এইচটিএস) নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি। আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট হায়াত তাহরির-আল-শাম নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি আগে জাবহাত আল-নুসরা নামে পরিচিত ছিল। সম্প্রতি ইদলিব থেকে একটি অতর্কিত হামলা শুরু করে তারা। তারপর আলেপ্পো, হামা, শেষ পর্যন্ত দামেস্ক দখল করে নিয়েছে এই গোষ্ঠী।
রাশিয়া আগে থেকেই বলে আসছে সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সমর্থনের পেছনে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য জড়িত থাকতে পারে। গত ৫ ডিসেম্বরও মার্কিন সাংবাদিক টাকার কার্লসনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বলেন, এটা একটা জটিল খেলা। অনেক ‘খেলোয়াড়’ এখানে জড়িত।
কেন আসাদের পতন গুরুত্বপূর্ণ
আসাদ সরকারের বিস্ময়কর পতন শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বৃহত্তর বিশ্বে কম্পন সৃষ্টি করেছে। আকস্মিক এমন পতন কয়েক দশক ধরে এই অঞ্চলে চলা বৃহৎ ক্ষমতার লড়াইয়ের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম অ্যাক্সিওস পোর্টালের তথ্য বলছে, সিরিয়ায় ১৪ বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি ত্বরান্বিত হয়েছিল মূলত ইসরায়েলের সঙ্গে হামাস, হিজবুল্লাহ ও বাশার আল-আসাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ অন্যান্য ইরান-সমর্থিত প্রক্সিগুলোর মধ্যে ১৪ মাসের যুদ্ধের মাধ্যমে।
হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার স্থপতি ইয়াহিয়া সিনওয়ার তার ‘বড় পরিকল্পনা’র কথা বলেছিলেন। সেটি হলো- ইরানপন্থী প্রতিরোধ অক্ষের মাধ্যমে ইসরায়েলকে ধ্বংস করে দেওয়া। কিন্তু ইসরায়েল প্রতিরোধ অক্ষগুলোকে অনেকটাই নড়বড়ে করে দিয়েছে। আর সবশেষ সিরিয়ার প্রেসিদেন্টের পতনের মধ্য দিয়ে মূলত ইয়াহিয়া সিনওয়ার-এর ‘বড় পরিকল্পনা’র পারদ নতুন মোড় নিল।
মার্কিন অ্যাক্সিওস পোর্টাল বলছে, রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিনও আসাদের সমর্থক। মস্কো তার পরাশক্তি মর্যাদা পুনরুদ্ধারে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ইউক্রেনে আক্রমণকে পরাশক্তি মর্যাদা পুনরুদ্ধারের মুকুটরত্ন হিসাবে দেখেছিলেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়াহিয়া সিনওয়ার এবং পুতিনের হিসাব ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ৫৩ বছর ধরে সিরিয়া শাসন করা আসাদ পরিবারের বিস্ময়কর পতনই এর স্পষ্ট প্রমাণ।
প্রাসঙ্গিক আরও কিছু
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত অনেক গুপ্তচর, কূটনীতিক ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা একমত যে, আসাদের মিত্র রাশিয়া ও ইরানের প্রতিরোধ দুর্বল হয়ে পড়ায় গত বছর ইসরায়েলে হামাসের আক্রমণের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়েছে।
রোববার হোয়াইট হাউস থেকে দেওয়া এক ভাষণে বাইডেন বলেন, ৭ অক্টোবরের (হামাসের ইসরায়েলে আক্রমণের দিন) পর যখন বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ হামাসকে প্রতিরোধের কথা বলছেন, তখন ইরান ও তার প্রক্সিগুলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বহুমুখী যুদ্ধ শুরু করার পথ বেছে নেয়। ইরানের দিক থেকে এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ভুল।
প্রতিরোধ অক্ষ চূর্ণ
অ্যাক্সিওস পোর্টালের তথ্য বলছে, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ ‘নিরাপত্তা ব্যর্থতার’ দিন। কিন্তু এর পরের সময়গুলোতে ইরানের প্রতিরোধ অক্ষ একের পর এক বিপর্যয়কর আঘাতের সম্মুখীন হয়েছে।
ইসরায়েলি বিমান হামলায় ক্যারিশম্যাটিক ও প্রভাবশালী নেতা হাসান নাসরুল্লাহকে হারিয়েছে ইরান। হিজবুল্লাহর সামরিক অবকাঠামো উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। লেবাননের এই গোষ্ঠীটি গত মাসে অত্যন্ত প্রতিকূল শর্তে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে।
এদিকে, ইসরাইল এক বছরেরও বেশি সময় ধরে গাজা উপত্যকায় বোমাবর্ষণ করে হামাসের সামরিক অবকাঠামো ধ্বংস করেছে এবং সিনওয়ার ও অন্যান্য অসংখ্য শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাকে হত্যা করেছে।
এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ইরান প্রথমবারের মতো ইসরায়েলের সরাসরি আক্রমণ করে। ইসরায়েলি অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফাঁকি দিয়ে এসব হামলা ইসরায়েলকে ভাবিয়ে তোলে। কিন্তু আসাদের পতন এখন ইরানকেই নতুন করে হিসাব-নিকাশ করাতে ভাবাচ্ছে।