Homeইতিহাসনাটোরের প্রত্ন গবেষক ও ঐতিহাসিক শরৎ কুমার রায়

নাটোরের প্রত্ন গবেষক ও ঐতিহাসিক শরৎ কুমার রায়

পরিচয়ঃ
বরেন্দ্র অঞ্চল নিয়ে গবেষণার প্রাথমিক যুগের অন্যতম উদ্যোক্তা শরৎকুমার রায় ১৮৭৬ সালে নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।পিতাঃ প্রমথ নাথ রায়। মাতা ধ্রুব ময়ী দেবী।বড় ভাই রাজা বসন্ত কুমার রায়।

লেখাপড়াঃ
শরৎ কুমার রায় প্রথমে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে লেখাপড়া করেন।অতপর কলকাতা রিপন কলেজ থেকে এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি,এ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞানে এম, এ ডিগ্রী অর্জন করেন, তিনি ১৯০০ সালে উচ্চতর গবেষণার জন্য লন্ডনে গমন গমন করেন।

বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদঃ
তার ওস্তাদ ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা বিনয় কৃষ্ণদেব, সহ অনেক দিকপাল পন্ডিতের সঙ্গে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

প্রথম অনুসন্ধানঃ
শর কুমার রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রী ও রমাপ্রসাদ চন্দ্র, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, রাম কমল সিংহ কে নিয়ে গঠিত পাঁচজনের একটি দল রাজশাহী অঞ্চলের মান্দাইল, কুমারপুর, খেতোর, বিজয়নগর প্রভৃতি প্রত্নস্হলে অভিযান চালায়প প্রচুর মূল্যবান প্রশ্ন নিদর্শন আবিষ্কার করেন।

বরেন্দ্র সোসাইটি গঠনঃ
রাজশাহীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল সমূহের মাহিস সন্তোষ, জগদ্দল মহাবিহার, মুকুন্দপুরের বাদাল স্তম্ভ, সোমপুর বিহার ও জয়পুরহাট এর খঞ্জনপুরে অনুসন্ধান কাজ শেষে ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাবুতে বসে সবাই মিলে বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।

সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পর পরই রাজশাহীতে ফিরে হয় সোসাইটির সভাপতি শরৎকুমার রায় পরি চালক অক্ষয় কুমারের মৈতীয়, সম্পাদক রমাপ্রসাদ চন্দ্র।সদস্য রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়,রাম কমল সিংহ সহ অনেকে।

নিবন্ধন প্রাপ্তিঃ
১৯১০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সোসাইটির কার্যক্রম শুরু হলেও ইন্ডিয়ান সোসাইটি অ্যাক্ট এর অধীনে ১৯১৪ সালে এই সোসাইটিটি নিবন্ধনকৃত করা হয়। ব্যয় নির্বাহের জন্য শরৎকুমার রায় প্রথমে ২০০ টাকা দান করে দানখাতার উদ্বোধন করেন।

বরেন্দ্র জাদুঘর স্থাপনঃ
সংগ্রহীত প্রত্ন সম্পদ সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের জন্য একটি জাদুঘর তৈরি প্রয়োজন পড়ে শরৎকুমার রায়ের বড় ভাই বশন্ত কুমার ছোট ভাই শরৎ কুমার দের আগ্রহের প্রতি সম্মান দেখিয়ে রাজশাহী শহরের প্রাণকেন্দ্রে বরেন্দ্র জাদুঘরের জন্য প্রয়োজনীয় জমি দান করেন।

শরৎ কুমার রায়ের ভাই বসন্তকুমার রায়ের জমির উপর বর্তমান এই রাজশাহী বরেন্দ্র জাদুঘরের ভবনটি স্থাপিত।নির্মাণের জন্য শরৎকুমার নিজে ৬৩ হাজার টাকা ব্যয়ভার বহন করেন।বাংলা লর্ড রোলান্ড ১৯১৯ সালের নভেম্বর মাসে বরেন্দ্র জাদুঘর উদ্বোধন করেন।

পাহাড়পুর খননঃ
শরৎ কুমার রায়ের আর্থিক সহায়তায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ পাহাড়পুর খননের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।১৯২৩ সালের পহেলা মার্চ শরৎ কুমার নিজে পাহাড়পুর খনন কাজের উদ্বোধন করেন। এই খনন কাজ শুরু হওয়ার পর একের পর এক বেরিয়ে আসতে থাকে বৌদ্ধ সভ্যতার সাহিত্য ও সংস্কৃতির, কৃষি ও ধর্মীয় অনুভূতির অনেক প্রাচীন নিদর্শন।

জাদুঘরে গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠাঃ
প্রত্ন নিদর্শন খননে উদ্ধারকৃত সামগ্রীর উপর গবেষণা কাজের সুবিধার্থে শরৎকুমার রায় রাজশাহী জাদুঘরে একটি গ্রন্থগার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের জন্য সংগৃহীত সমস্ত গ্রন্থ ও পান্ডুলিপি সমূহ তিনি এই গ্রন্থাগারের জন্য দান করেন।

দয়রামপুরে গ্রন্থাগার স্থাপনঃ
শরৎ কুমার রায় শহরের মানুষের পাশাপাশি গ্রামের মানুষদের শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে তিনি তার নিজস্ব জমিদারি দয়ারামপুরে অবহেলিত মানুষের জন্য সেই অঞ্চলে একটি বৃহৎ গ্রন্থকার স্থাপন করেন।

রাজশাহীতে কৃষি কলেজ স্থাপনঃ
বরেন্দ্র জাদুঘরের পরিচালক শরৎ কুমারের বড় ভাই বসন্তকুমার শরৎকুমার ও তার বন্ধুদের উৎসাহে অনুপ্রাণিত হয়ে রাজশাহীতে একটি কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং ১৯২০ সালে এই ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য রাজশাহী কলেজকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা দান করেন সেই সময় এত পরিমাণে টাকা দান অকল্পনীয়।

কৃষি ইনস্টিটিউট স্থাপনঃ
শরত কুমার রায় ১৯৩৬ সালে রাজশাহী কলেজে নিয়ন্ত্রণে বসন্তকুমার কৃষি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। ইনস্টিটিউট টি ১৯৫২ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।১৯৪৬ সালে শরৎকুমার রায়ের মৃত্যুর পর কৃষি ইনস্টিউটটির
কার্যক্রম ক্রমে দুর্বল হতে থাকে।১৯৫২ সালে এটি বন্ধ হয়ে যায়।

চিনিকল স্থাপনঃ
উত্তর বাংলায় শরৎকুমার রায় প্রথম একটি চিনিকল স্থাপন করেন। এই অঞ্চলে এটি ছিল এই ধরনের প্রথম চিনিকল খামারেসাধারণ কৃষকদের উৎপাদিত আখের সাহায্যে তিনি চিনিকলটি সব সময় চালু রাখার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

দ্রবময়ী কৃষি খামারঃ
শরৎ কুমার রায় তার জমিদারী দয়ারামপুরে তিনশত বিঘা জমির উপর একটি কৃষি খামার প্রতিষ্ঠা করেন। সঙ্গে একটি দুগ্ধ খামারও স্থাপন করেন। বহুমুখী পরিকল্পনার এই এই রাজপুত্র তার উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে উত্তরবঙ্গে যথা সম্ভব উন্নয়নের চেষ্টা করে গেছেন তার মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত।

সাহিত্য সাধনাঃ
তার লেখা গ্রন্থ সমূহ (১) ভারতীয় সাধক(২) বৌদ্ধ ভারত(৩) শিখ গুরু ও শিখ জাতি(৪) শিবাজী ও মারাঠা জাতি (৫) মহাত্মা অশ্বিনী কুমার (৬)মহলাল।

মৃত্যুঃ
১৯৪৬ সালে ১২ই এপ্রিল উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের রূপকার রাজশাহী শহরের জনমানুষের প্রাণপুরুষ শরৎকুমার রায় মৃত্যুবরণ করেন।

লেখকঃ অধ্যাপক মোঃ আব্দুর রাজজাক রাজু
গ্রন্থঃ বরেন্দ্রভূমির বরেণ্যরা। পর্বঃ ৫৬

সর্বশেষ খবর