আগামী জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা প্রশ্নে বাড়ছে বিতর্ক। অন্তর্বর্তী সরকার স্পষ্ট না করলেও, উপদেষ্টারা মাঝেমধ্যে নিজের মতামত জানাতে গিয়ে ইস্যুতে ঘি ঢালছেন। মাঠ পর্যায়ে দেখা দিচ্ছে অসন্তোষ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অংশীজন অনেকের মধ্যেই তৈরি হয়েছে মতানৈক্য। বিষয়টি ভালোভাবে নিচ্ছে না বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নেতাদের ভাষ্য, দ্রুত নির্বাচন আয়োজন নিয়ে সরকারের একটি অংশের চরম অনীহা রয়েছে। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার জন্য তারাই ষড়যন্ত্র করছে। নির্বাচন আয়োজনে দেরি হলে রাজনৈতিক সংকট বাড়বে। পরাজিত শক্তির অপতৎপরতায় দেখা দেবে অস্থিরতা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর পর সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা সংলাপে বিএনপি অংশ নিয়ে আগামী নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি। বরং তারা রাষ্ট্র সংস্কারের বিভিন্ন ধাপ শেষে নির্বাচন আয়োজনের কথা জানিয়েছে। এরই মধ্যে গত মঙ্গলবার সরকারের নৌ পরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেনের বক্তব্যে নির্বাচন ইস্যুতে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডসে মানবাধিকার সংগঠন ‘ভয়েস ফর বাংলাদেশ’ আয়োজিত কনফারেন্স শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি নির্বাচন হতে পারে।’ অথচ ওই দিনই সচিবালয়ে সরকারের ১০০ দিন উপলক্ষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমরা খুব প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেব।’
তা ছাড়া সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে আলজাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস সরকারের সময়সীমা প্রশ্নে বলেছেন, ‘আমরা অন্তর্বর্তী সরকার; স্থায়ী নই। নিয়মিত সরকার পাঁচ বছরের। নতুন সংবিধানে সরকারের মেয়াদ চার বছর হতে পারে। কারণ, মানুষ আরও দ্রুত সময়ে সরকারের পরিবর্তন চায়। কাজেই এটি (অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ) নিশ্চিতভাবে চার বছরের কম হবে। তারও কম সময়ে হতে পারে। তবে তা পুরোপুরি নির্ভর করছে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার ওপর।’ পরে এ উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচনী সংস্কারের সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে খুব দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপও (রূপরেখা) পাওয়া যাবে। নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না।’
বিএনপি নেতারা বলছেন, রোডম্যাপ দেওয়ার পরও নির্বাচন কয়েক মাস বিলম্বিত হতে পারে। সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের কার্যক্রমে বিএনপির কোনো বিরোধিতা নেই। তারা সরকারকে সহযোগিতা করছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য যেহেতু নির্বাচন, তাই যেসব সংস্কার একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত, রাজনৈতিক মতৈক্যের ভিত্তিতে সেসব সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানিয়ে তারা বলছেন, ২০০৮ সাল থেকে দেশে ‘ভোট ভোট খেলা’ হয়েছে। কেউই তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেননি। মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছেন– বিষয়টি সরকারের বোঝা উচিত। জনগণের ভোটাধিকার ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা পূরণে যত দ্রুত নির্বাচন দেওয়া হবে, তত দেশের জন্য মঙ্গল। তাহলে পতিত স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্রও সফল হবে না।
এ বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, সরকারের দায়িত্বশীলরা একেক সময় একেক কথা বলছেন। তাদের কথায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। তবে তাদের ফোকাস নির্বাচন আয়োজনে হওয়া দরকার। নির্বাচন কমিশন ঠিক করা হয়েছে। এখন প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে ঠিক করে নির্বাচনের দিকে যেতে হবে। সংস্কারের বাকি কাজ যারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, তারা করবে।
তিনি বলেন, আমরা যতবার নির্বাচন নিয়ে কথা বলি, ততবারই সরকার বলে– আমরা (রাজনৈতিক দল) শুধু নির্বাচন নির্বাচন করি। আমরা নির্বাচন দিতে বলি জাতির স্বার্থে। বিএনপির স্বার্থে তো বলছি না। একটি বিষয় সবার স্বীকার করতে হবে, বর্তমান সরকারের কারও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা নেই। এর আলাদা যোগ-বিয়োগ, আলাদা ইকুয়েশন আছে, যেটি রাজনীতিকরাই বুঝতে পারেন। নির্বাচন দ্রুত না হলে দেশের সমস্যা আরও বাড়বে।