বছরের পর বছর ধরে অন্তহীন অপেক্ষার যেন অবসান ঘটতে চলেছে এবার। ক্রমশ খুলছে রহস্যের জট। অন্ধকার ভেদ করে মিলছে আলোর দিশা। অবশেষে ঘটনার ১৩ বছর পর সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে। বহুল আলোচিত এই হত্যা মামলা তদন্তে গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের সূত্রে জানা গেছে, আগামী এপ্রিলের মধ্যেই মামলার তদন্ত শেষ হবে বলে তারা আশা করছেন। র্যাবের কাছ থেকে তদন্তের দায়িত্ব তুলে নিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই টাস্কফোর্সকে, যেখানে সম্পৃক্ত রয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনপিবিআই। গত মঙ্গলবার এই মামলার বাদী ও পিবিআই সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
শুধু তাই নয়, তদন্ত সংস্থাগুলোর অনুসন্ধানে এ হত্যাকাণ্ডের অনেক রহস্যের জট খুলতে শুরু করেছে বলে জানা গেছে। নাটকীয় মোড় নিচ্ছে তদন্তের গতিপথ। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী সামিট গ্রুপের জড়িত থাকার কথা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে তারা। অনেক দিন ধরেই এ রকম আশঙ্কার কথা আলোচনায় থাকলেও এবার তা তথ্য-প্রমাণসহ উন্মোচিত হওয়ার পথে।
পিবিআই সূত্র জানায়, তদন্ত এত দিন বিশেষ একটা কারণে ভিন্ন পথে ছিল। জট পাকানোর কারণে মামলার ফাইল বন্ধই ছিল বলা চলে। মাঠে নেমে তারা সেই জটলা ভেদ করে গন্তব্যে পৌঁছার মতো কিছু সূত্র পেয়েছে এবং সে লক্ষ্যেই এগোচ্ছে। প্রাথমিকভাবে তারা জানতে পেরেছে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সামিট গ্রুপের দুর্নীতির নথিপত্র সাগর-রুনির হাতে এসে পড়ার কারণে ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। এ ব্যাপারে আরও সাক্ষ্যপ্রমাণ ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজ চলছে।
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি দম্পতি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এই মামলার তদন্তে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তদন্তকাজে অভিজ্ঞ বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করতে বলা হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত থেকে র্যাবকে সরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেওয়া হয়। এরপর গত ১৬ অক্টোবর হাইকোর্ট বেঞ্চ এক পূর্ণাঙ্গ আদেশে আগামী ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলেন। সাংবাদিক দম্পতি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমার তারিখ এখন পর্যন্ত ১১৩ বার পেছানোর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এই কঠোর নির্দেশ দেন বলে জানা যায়।
তদন্তে সম্পৃক্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, মামলার অবস্থান বা অগ্রগতি নিয়ে তাদের মুখ না খুলতে কঠোরভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা এর আগে তদন্তে সম্পৃক্ত ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা সংবাদমাধ্যমের কাছে যে যার মতো করে মুখ খুলে এবং উল্টাপাল্টা তথ্য দিয়ে নিহতদের পরিবার ও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন। ফলে এখন বলার মতো কিছু হলে বা প্রয়োজন মনে করলে সেটা সম্মিলিত সিদ্ধান্তে টাস্কফোর্সের মাধ্যমেই বলা হবে। তারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আদালত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এই তদন্ত শেষ করতে।
তিনি আরও জানান, টাস্কফোর্সে চারটি সংস্থার সদস্য রয়েছেন। শীর্ষপর্যায়ে আছেন অতিরিক্ত উপমহাপুলিশ পরিদর্শকের নিচে নন চার বিভাগের এমন চার কর্মকর্তা। চারটি বিভাগ হচ্ছে পুলিশ সদর দপ্তর, সিআইডি, র্যাব ও পিবিআই। তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট কাজগুলো বেশিরভাগ করতে হচ্ছে পিবিআইকে।
নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, টাস্কফোর্সের তদন্তে এই হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে সামিট গ্রুপের সম্পৃক্ততার কথা বের হয়ে আসছে। তবে আরও নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তারা এ ব্যাপারে কিছু বলতে নারাজ। এ বিষয়ে কথা বলতে গত মঙ্গলবার রাতে সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান এবং জনসংযোগ বিভাগের প্রধানকে কয়েকবার ফোন করা হয়। আজিজ খানের মোবাইল ফোন নম্বরে রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে একজন ফোন ধরলেও পরিচয় জানার পর তিনি আর কোনো কথা বলেননি। এরপর তিন থেকে চারবার ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ করা হলেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। অপরদিকে সামিটের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান ফোনই রিসিভ করেননি।
বিচারের অপেক্ষায় মেঘ
এদিকে সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মেঘ কার কাছে থাকবে তা নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে যে আইনি লড়াই চলছিল সেই জটিলতাও শেষ হয়েছে। গত ১৬ জুন মেঘ ১৮ পেরিয়ে ১৯ বছরে পা দিয়েছে।
মেঘ কার কাছে থাকবে সেই ইস্যুতে মুখোমুখি চলে আসে সাগর ও রুনির পরিবার। মেঘকে নিয়ে দুই পরিবারে দেখা দেয় শীতল যুদ্ধ। স্নেহ-ভালোবাসার অধিকার থেকে দেখা দেওয়া এই বিরোধে একপর্যায়ে মেঘের অভিভাবকত্ব নিয়ে আদালতের দুয়ারে হাজির হন দাদি ও নানি। মেঘের নানি নূরুন্নাহার মির্জা ২০১৫ সালে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মেঘের পড়াশোনা, ভরণপোষণ ও অভিভাবকত্ব দাবি করে মামলা করেন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মেঘের নানি মারা যান ২০২২ সালে।
এই মামলার আইনজীবী ও মানবাধিকার নেত্রী অ্যাডভোকেট এলিনা খান গত মঙ্গলবার বলেন, আদালত এই বিরোধের সুরাহা করে দিয়েছেন ২০২১ সালের শুরুতেই। পারিবারিক আদালত যে রায় দেন, সেখানে বলা হয়েছে মেঘের শারীরিকভাবে সার্বিক দেখভালের দায়িত্ব পাবেন তার নানি। নানির অবর্তমানে সেই দায়িত্ব বর্তাবে তার মামা নওশের আলম রোমানের ওপর। অপরদিকে সম্পত্তি বণ্টনের ব্যাপারে বলা হয়েছে, রুনি তার পারিবারিক সূত্র থেকে যে সম্পত্তি পাবেন সেটার আপাতত দায়িত্ব পাবেন মেঘের নানি। তার অবর্তমানে সেই দায়িত্ব বর্তাবে মেঘের মামা রোমানের ওপর। অপরদিকে সাগরের পারিবারিক সূত্র থেকে মেঘ যে সম্পত্তি পাবে সেটার আপাতত মালিক হবেন দাদি সালেহা মনির এবং তার অবর্তমানে ফুফু মঞ্জু আরা পারভীন। তবে এর সবকিছুই বলবৎ ছিল মেঘের বয়স আঠারো বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত। মেঘের বয়স এখন ১৮ পূর্ণ হয়েছে। মেঘ এখন থেকে তার নিজের সিদ্ধান্তেই চলতে পারবে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে মা-বাবার সকল সম্পত্তির মালিক হবে।
রুনির ভাই এবং এই হত্যা মামলার বাদী নওশের আলম রোমান গত মঙ্গলবার বলেন, তারা র্যাব, পুলিশ খেলা দেখতে দেখতে হতাশ হয়ে এই মামলার রায়ের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর মেঘ তার নানিকে ‘আম্মা’ ডাকা শুরু করে। মেঘের সেই আম্মাও ২০২২ সালের শুরুতে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। এক এক করে সব অভিভাবক হারিয়ে ফেলছে মেঘ। মেঘের সাড়ে ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত নানিই তার দেখভাল করতেন। নানিকে আম্মা ডেকে মায়ের অভাব ভুলে থাকার চেষ্টা করত মেঘ। নানির মৃত্যুতে মেঘ আরেকবার এতিম হয়ে যায়। আমরাই এখন তার একমাত্র আপনজন। আগে সে মৃত্যু কী সেটা ভালোমতো বুঝত না। যতই বড় হচ্ছে, ততই সে নিজেকে বুঝতে শিখছে। জানার আগ্রহও বাড়ছে। আর এখন সেও বারবার জানতে চায় তার বাবা-মায়ের খুনি কারা, কেন তাদের এভাবে মেরে ফেলা হয়েছে? এর বিচার হবে কবে? খুনিরা কি আদৌ সাজা পাবে?
কথা হয় মেঘের সঙ্গেও। গত মঙ্গলবার মেঘ জানায়, সে এখন এ-লেভেল করছে। তাই লেখাপড়া নিয়ে বেশ ব্যস্ত। মেঘ বলে, ‘বাবা-মায়ের খুনিরা এত দিনেও শনাক্ত হয়নি, এমনকি কেন তাদের খুন করা হলো সেটাও জানা যায়নি। পুরো পরিবারের সঙ্গে আমিও হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। এখন নতুন সরকার এসেছে। নতুনভাবে তদন্ত শুরু হয়েছে। আশা রাখি, এবার হয়তো আমি সুবিচার পাব।’
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ভাড়া বাসায় এই জোড়া খুনের ঘটনার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এর কয়েক দিন পর পুলিশপ্রধান জানিয়েছিলেন, তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে মামলা হওয়ার পর প্রথমে তদন্তে নামে শেরেবাংলা থানা পুলিশ। এরপর চার দিনের মাথায় তদন্ত হাতবদল হয়ে যায় ডিবি পুলিশের কাছে। ৬২ দিনের মাথায় ডিবির তদন্ত থমকে গেলে তদন্তের দায়িত্ব পায় র্যাব। তারা সাগর-রুনির মরদেহ কবর থেকে তুলে আবার ময়নাতদন্ত করে। দেশ-বিদেশে ভিসেরা পরীক্ষাও করা হয়। কিন্তু র্যাবের হাতে এসেও হঠাৎ থমকে যায় তদন্তের গতি। রহস্যের জট তো খোলেইনি, বরং আরও ঘনীভূত হয়। হত্যার কারণ নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে নানা রকম গুজব আর ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব।
এই পরিস্থিতিতে নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, মামলার তদন্তের নামে যা হচ্ছে সবই নাটক। এই খুনের নেপথ্যে প্রভাবশালীদের কেউ জড়িত, তা না হলে তদন্তের নামে এমন প্রহসন কেন? পুলিশ গ্রিল কাটা চোর নিয়ে মহড়া করে সেটা ভিডিও করে। মানে চোর তত্ত্বও বাজারে এসেছে। এ রকম নানা তত্ত্ব যখন বাজারে ছড়ায়, তখন বোঝা যায় যে ঘটনার আসল তদন্ত হচ্ছে না। এসব গুজব অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছড়ানো হয়।
মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, তিনি শুরু থেকেই এই মামলার কার্যক্রমের ওপর নজর রাখছিলেন। তার মতে, এত দিন কয়েকটি কারণে তদন্ত থেমে থাকতে পারে। প্রথমত, এ ঘটনায় এমন প্রভাবশালী কেউ জড়িত, যার কেশাগ্র স্পর্শ করার ক্ষমতা বিগত সরকারের ছিল না। দ্বিতীয়ত, এ ঘটনায় এমন একটা পাবলিক পারসেপশন তৈরি হয়েছে যে এর বিপরীত কোনো তথ্য তদন্তে বের হলেও তা প্রকাশ করতে পারছেন না তদন্তকারীরা। কোনো মামলায় যখন নানা রকম চাপ কিংবা বাধা তৈরি হয়, তখন অনেক সময় তদন্ত সংস্থা তদন্ত শেষ না করে সময়ক্ষেপণের কৌশল নিয়ে থাকে। এখন বাধাটা কোথায় ছিল, নতুন তদন্তে সেটা হয়তো সুস্পষ্টভাবে বের হয়ে আসতে পারে।
সূত্র: প্রতিদিনের বাংলাদেশ