পরিচয়
দেবী চৌধুরানীর আসল নাম জয়দুর্গা দেবী। পিতাঃ ব্রজকিশোর চৌধুরী। মাতাঃ কাশীশ্বরী দেবী। গ্রাম দুর্গাপুর। উপজেলা কাউনিয়া। জেলা রংপুর। তার জন্ম হয় প্রত্যন্ত দুর্গাপুর গ্রামে। আত্মীয় স্বজনের দেওয়া নাম ছিল প্রফুল্ল। তার জমিদারির সময়কাল১৭০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ।
বিয়ে
দেবী চৌধুরানীর গ্রাম দুর্গাপুর থেকে ১৪ কিঃমিঃ দূরে ভূতনাথ গ্রাম। এই ভূতনাথ গ্রামের জমিদার হরবল্লব চৌধুরীর একমাত্র পুত্র নারায়ণচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
জমিদারি
তার স্বামী জমিদার নারায়ণচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পরে ১৭৬৫ সাল থেকে তিনি মন্থরা স্টেটের জমিদারির দায়িত্ব পান।১৮০১ সাল পর্যন্ত এই স্টেটের দায়িত্ব ও জনহিতকর কার্য অতি বিচক্ষণতা ও দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন।
বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা
দেবী চৌধুরাণীর স্বামী জমিদার থাকা অবস্থায় রংপুর অঞ্চলের কালেক্টর হয়ে আসেন জনাথন গুডলাড। তার দেওয়ান নিযুক্ত হন স্হানীয় দেবীশিংহ। দেবীশিংহ তার অত্যাচারী কর্মচারী হরেরামের উপর রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। তাদের অত্যাচারে সাধারণ কৃষক এমনকি স্হানীয় জমিদাররাও অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।
নীল চাষে বাধ্যকরন
সে সময় ইংরেজ নীলকরদের অত্যাচার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তারা জোরপূর্বক উর্বর জমিতে কৃষকদের নীল চাষ করতে বাধ্য করত। তার ফলশ্রুতে দেবী চৌধুরানী ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হন।
দেবী চৌধুরানী জয়লাভ
বিদ্রোহের কারণে তিনি ইংরেজদের রোসানলে পড়েন। তাকে দমন করার জন্য মীর কাসেমের নেতৃত্বে ইংরেজরা একদল সেনাবাহিনী পাঠায়।দেবী চৌধুরানী সঙ্গে রংপুরের নুরুদ্দিন বাকের মোহাম্মদ জাং,ও ভবানী পাঠকের মত বাঘা বিপ্লবী অংশগ্রহণ করেন।
জনতার অংশগ্রহণ
রানী ভবানীর সঙ্গে দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া অঞ্চলের কৃষক অসাধারণ জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধ ১৭৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হয়। যুদ্ধে ইংরেজ ক্যাপ্টেন সহ অনেক ইংরেজ সৈন্য মারা যায়। মীর কাশেম পিছু হোটেন। রানী ভবানী বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন।
যুদ্ধের প্রতিশোধ
পীরগাছা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামে লর্ড ওয়ারেন্ট হেলড এর নেতৃত্বে ১৭৮৩ সালে এপ্রিল মাসে বৃহস্পতি বার এক দল ইংরেজ সৈন্য আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রণাঙ্গনে আসেন। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত চৌকুষ ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে দেবী চৌধুরানী নাপাইচন্ডী নামক স্থানে নিহত হন। তার সঙ্গে অন্নদা নগরের জমিদারও নিহত হন। এতে এলাকায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন অনেকটাই স্থমিত হয়ে পড়ে।
বঙ্কিমচন্দ্রের অভিমত
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইংরেজ শাসনামলে রংপুর জেলার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সেখানকার স্থানীয় জনশ্রুতি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে দেবী চৌধুরানী উপন্যাসটি রচনা করেন।দেবী চৌধুরানী গ্রন্থ সম্পর্কে ১৮৮৪ সালে লেখক নিজেই বলেছেন দেবী চৌধুরানী গ্রন্থের সঙ্গে ঐতিহাসিক দেবী চৌধুরানীর মিল বড়ই কম। লেখক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
যদুনাথ সরকারের অভিমত
রংপুর অঞ্চলের মানুষের কাছে পরিচিত প্রফুল্লই যে দেবী চৌধুরানী ছিলেন সেটাই আজও সর্বজন স্বীকৃত।
এখনো রংপুরের কৈকুড়ি ইউনিয়নের মুকসুদখাঁ গ্রামে দেবী চৌধুরানীর স্থাপনার জায়গায় ঈটের টুকরো এখনো দেখতে পাওয়া যায়।- ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার।
জনহিতকর কর্ম
জনকল্যাণে খননকৃত দেবী চৌধুরানীর দীঘি, চন্ডিপুর দিঘী, মন্থনা রাজবাড়ী কালের স্বাক্ষর হয়ে আজও ঠিকে আছে। চৌধুরানী বাজার এলাকায় জনপ্রিয়। দেবিগঞ্জ বাজারও তার স্মৃতি বহন করে।
টিভিতে সিরিয়াল
বাংলাদেশের রংপুরের দেবী চৌধুরানীর সত্য ঘটনার উপরে নির্ভর করে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস অবলম্বনে রচিত দেবী চৌধুরানী সিরিয়ালটি ১৬ জুলাই ২০২৪ সাল থেকে স্টার জলসা টিভিতে বাংলাদেশ সময় রাত ০৮.০০ নিয়মিত প্রচারিত হয়ে আসছে।
তথ্যসূত্র
আনন্দবাজার” পত্রিকা উৎসব ৩১/০৭/২০২১ সন। মানবজমিন – দেবী চৌধুরানী আইন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা- ২৯/০৭/২০২৪সন। এইচ এম, শরিফুল হাসান- বিডি নিউজ ২৪/০৫/২০২৩সন। সুমনা চক্রবর্তী বাংলার ব্যান্ডেড কুইন- ৩১/০৭/২০২১ সন।
লেখকঃ অধ্যাপক মোঃ আব্দুর রাজজাক রাজু।
গ্রন্থঃ বরেন্দ্রভূমির বরেণ্যরা। পর্বঃ ৫৯