সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন উপাচার্য নিয়োগ করেছে সরকার। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর বেশিরভাগ নতুন উপাচার্য পদত্যাগ করেন। ফলে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়ে। আশা করা হচ্ছে সরকার শিগগিরই বাকি সব উপাচার্য এই নিয়োগ সম্পন্ন করবে।
এদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ। উচ্চশিক্ষা সংস্কারের প্রথম ধাপ হিসেবে এই নিয়োগগুলোকে অনেকেই স্বাগত জানিয়েছেন।
এইসব নিয়োগে দলীয় লেজুড়বৃত্তিকে পরিত্যাগ করে শিক্ষকের গবেষণা ও একাডেমিক উৎকর্ষতাকে (Academic Excellence) বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। স্বৈরাচারী আমলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নিয়োগ দেওয়া হতো দলীয় আনুগত্য বিবেচনায়। শিক্ষক নিয়োগকে পরিণত করা হয়েছিলো ভোটার নিয়োগ প্রক্রিয়ায়। একাডেমিক উৎকর্ষতার বিষয়টি ছিল গৌণ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে বড় অধ:পতন শুরু হয় ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিজেদের লোক বাড়ানোর জন্য অবাধে দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক শুরু হয়। যোগ্য ও মেধাবীদের বাদ দিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নিয়োগ শুরু হয়। প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় ছাত্রলীগের পুনর্বাসন কেন্দ্রে। যাদের মোটামোটি যোগ্যতা আছে তাদের শিক্ষক এবং বাকীদের বিভিন্ন প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দেয়া হয়। সেসময় শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণের নিকৃষ্ট উদাহরণ ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। তখন বেশ কয়েকটি বিষয় (Subject) খোলা হয় শুধুমাত্র আওয়ামীপন্থী ভোটার বাড়ানোর জন্য। আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষকদের বাদ দিয়ে ইতিহাসের ছাত্র, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করাদের নিয়োগ দেয়া হয়। তৎকালীন সাপ্তাহিক ২০০০ পত্রিকা এ নিয়ে কাভার স্টোরিও করেছিল। কিন্তু কোন সমালোচনা তাদের দমাতে পারেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী শিক্ষকরা ছিলেন আরও একধাপ এগিয়ে। কমযোগ্যদের সরাসরি প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ দিলে পত্রিকায় লিখা হবে, সমালোচনা হবে; তাই তারা কম যোগ্যদের ঢাকার বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রথমে নিয়োগ দেওয়া হতো। পরে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে তাদের আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা হতো।
রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয়ে আইন বিভাগে কয়েক মাস পড়েছিলাম। দলীয় ভোটার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া একজন শিক্ষক ক্লাস নিতেন। প্রথম ক্লাসে এসেই স্যার বললেন, আমি ইংরেজীতে ভাল না। তাই আমি বাংলাতেই তোমাদের পড়াব। স্যার তার কথার রেখেছিলেন। বিশুদ্ধ বাংলায় ক্লাস নিতেন। ভুল করেও কোন ইংরেজী শব্দ মুখে আনতেন না। তার বাবা আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন, পরে মন্ত্রীও হয়েছিলেন। ওই শিক্ষকও পরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে নিয়োগ পেয়েছিলেন। উচ্চ শিক্ষার তদারকিও করে গেছেন !!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেও একই অবস্থা পেলাম। এখানে এসে জানলাম, শুধু ভাল ফলাফল করলেই হয় না। এখানে শিক্ষক হওয়ার জন্য রাজনৈতিক পরিচয়টাই মুখ্য। এ প্রসঙ্গে একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের প্রথম ক্লাসেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন শিক্ষক এলেন। ক্লাসের প্রথম দিনই তিনি শিক্ষার্থীদের ১০টি গ্রুপে ভাগ করেন এবং প্রত্যেক গ্রুপকে সিলেবাসের দশটি বিষয় ভাগ করে এ্যাসাইমেন্ট দিয়ে দেন। একেকটা চ্যাপ্টার একেক গ্রুপকে দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ সময় দেন। সঙ্গে এও জানিয়ে দেন যে, এক সপ্তাহ পর এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিলেই তিনি ক্লাস শুরু করবেন। সে পর্যন্ত তার ক্লাস বন্ধ থাকবে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে অনেকে এ্যাসাইনমেন্ট শব্দটির সঙ্গেই পরিচিত ছিলনা। এ্যাসাইমেন্ট কি জিনিস তা বুঝার আগেই কোন এ্যাসাইমেন্ট করা আসলেই কঠিন ছিল। তাছাড়া, যে বিষয়ে এ্যাসাইমেন্ট করতে হবে তাও একদম নতুন। ইংরেজী বই পড়তে হবে। যাই হোক সবার দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। বড় ভাইদের কাছে ধর্ণা দিতে হয়। অবশেষে সকল বাধা পেরিয়ে এক সপ্তাহ পর সবাই এ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়। শিক্ষকও ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। পরে জানলাম এ্যাসাইনমেন্ট চলাকালীন স্যারের (ছাত্রলীগ নেতা) ক্লাস না নেওয়ার রহস্য। স্যার ছাত্র নেতা থেকে শিক্ষক হয়েছেন। শ্লোগান দিতে অভ্যস্ত শিক্ষক পড়াশোনার সময় তেমন পাননি। তাই নিজে কষ্ট করে পড়ার চেয়ে শিক্ষার্থীদের দিয়ে এ্যাসাইনমেন্ট তৈরি করে বিষয়টিকে সহজ করে নেন। আর তাদের জমা দেওয়া এ্যাসাইনমেন্ট পড়েই তিনি ক্লাসে লেকচার দেন। পত্রিকায় দেখলাম বৈষম্য বিরোধী শিক্ষার্থীরা তাকেসহ আরো কয়েকজন শিক্ষককে অব্যাহতি দেয়ার জন্য বিক্ষোভ মিছিল করছে। এটা অস্বীকার সত্যি যে, এধরনের শিক্ষকরাই ছাত্রদের মূল্যায়ন করেন চেহারা দেখে, দলীয় পরিচয় দেখে, এলাকা দেখে। অনেক সময় এরাই ঠিক করেন বিভাগে প্রথম কে হবে, কে শিক্ষক হবে। এসবতো ১৯৯৬ যুগের আওয়ামী শিক্ষকদের কথা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরের চিত্র আরো ভয়ংকর, অনেকের জানা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক রিপোর্ট অনুযায়ী দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক (প্রভাষক) নিয়োগের ক্ষেত্রে ৩ থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। আওয়ামীলীগের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাবশালী শিক্ষক, ছাত্র নেতা, উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ডিন, বিভাগীয় প্রধানদের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে টাকার বিনিময়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়। এছাড়া শিক্ষকের সন্তান, স্বামী, স্ত্রী, শ্যালক, শ্যালিকা ও আত্মীয়দের নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেছে। এরা এমন সব মানুষদের নিয়োগ দিয়েছে যাদের সাধারণ কলেজেও শিক্ষকতার যোগ্যতা নেই। এদের নিয়োগের মূল যোগ্যতা ছিল ক্ষমতাসীন দলের কর্মী বা নেতা। সবচেয়ে দু:খজনক ব্যাপার হলো তাদের দলীয় পরিচয় পুলিশ ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়। বিরোধী মতের হলেই বাদ দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ এ্যাওয়ার্ড পাওয়ারা পাত্তা পায়নি দলীয় পান্ডাদের কারণে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরিণত করা হয় মেধাহীন ফ্যাসিস্টদের মুক্তভূমিতে।
বিভিন্ন বিভাগে প্রথম হওয়াদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার একটি রীতি থাকলেও বিগত স্বৈরাচারী সরকার সব নিয়ম পাল্টে সিরিয়ালে দশের পর থাকাদের নিয়োগ দিয়ে অনিয়মের রেকর্ড গড়েছিল। এই কাজটি নগ্নভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু করেন তৎকালীন প্রো-ভিসি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ। এটা পরবর্তীতে অব্যাহত থাকে। টাকার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ আওয়ামী লীগের শিক্ষকরাই করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে মুক্তচিন্তা ক্ষেত্র থেকে ফ্যাসিন্ট ক্যাম্পাসে পরিণত করার দায় এই শিক্ষকদেরও নিতে হবে। বিশ্বিবিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন শিক্ষককে অব্যাহতি দেয়ার যে শ্লোগান ক্যম্পাসে শুরু হয়েছে তা তাদের কর্মফলেরই নামান্তর। প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক হিসেবে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের নিয়োগ দিয়ে শিক্ষকদের আচরণও নিম্নমাত্রায় নামিয়ে এনেছিল। এসব ক্যাডার তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আচরণও করেছিন ক্যাডারের মতোই। চোখের সামনে এসব অনিয়মই ক্যাম্পাসের তরুণদের বিপ্লবে উৎসাহী করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করতে হলে অবশ্যই শিক্ষককে আগে বিশ্বমানের হতে হবে। দলীয় ক্যাডারদের শিক্ষক আর ভিসি হিসেবে নিয়োগ দিলে শিক্ষার মানের যে নিম্নগতি তা ঠেকানো যাবে না। তবে রাজনীতিক পরিচয় সবসময় নেতিবাচক নয়। শিক্ষাগত উৎকর্ষতার প্রাধান্য আছে এমন শিক্ষককের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দোষের নয়। পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশে লেকচারার পদটিই নেই। সেখানে প্রথম নিয়োগই হয় সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। দরকার হয় পিএইডি ডিগ্রীর। আর এখানে স্নাতক পাশ করেই শিক্ষক হওয়ার সুযোগ থাকায় অনিয়ম আরো বেড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হলে এসব বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষার সব স্তরে শিক্ষক নিয়োগে যাচাই বাছাই করার রীতি থাকলেও এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এর বালাই নেই। এখানে নিয়োগের একমাত্র পদ্ধতি হলো মৌখিক পরীক্ষা। এর বড় কারণ কাকে নিয়োগ করা হবে তা আগে থেকেই চুড়ান্ত করা থাকে। মৌখিক পরীক্ষা শুধু নিয়ম রক্ষা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা নিশ্চিত করতে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের বিকল্প নেই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োজিত বাংলাদেশী মেধাবীদের দেশে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিতে হবে। কমপক্ষে পিএইচডি ডিগ্রীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের প্রধান যোগ্যতা নির্ধারন করতে হবে। দলীয় মনোবৃত্তির বাইরে গিয়ে মেধাবীদের মূল্যায়ন নিশ্চিত করতে হবে। মেধাবী ও যোগ্যরা শিক্ষকতায় আসার উৎসাহ সৃষ্টির জন্য নতুন নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যরা ভূমিকা রাখবেন। এমন আশা জাতি করতেই পারে।