বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। বর্তমানে ভারতে রয়েছেন তিনি। সেখানে বসেই দেশ নিয়ে মন্তব্য করতে দেখা গেছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে। ভারতে বসে হাসিনা দেশ নিয়ে মন্তব্য করায় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
ভারতের রণকৌশলগত বিশেষজ্ঞ মহলের বরাত দিয়ে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করেছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম আনন্দবাজার।
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার মন্তব্য, হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশের সমস্তটাই ইসলামি রাজনৈতিক শক্তি, এমন ভাবনা ছাড়তে হবে ভারতকে। এ বিষয়ে আনন্দবাজার নয়াদিল্লির রণকৌশলগত বিশেষজ্ঞ মহলের বক্তব্য তুলে ধরেছে প্রতিবেদনে।
বিশেষজ্ঞ মহলের বক্তব্য, অন্তর্বর্তী সরকারের সাম্প্রতিক কাজকর্মে যে নকশা ফুটে উঠছে, তাতে মনে হচ্ছে বাংলাদেশ মৌলবাদীদের নতুন স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। তাঁদের কথায়, অন্তর্বর্তী সরকারের চলতি পদক্ষেপগুলি শুধুমাত্র বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রাণই বিপন্ন করছে না, বৃহত্তর আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও বিপদের মুখে ফেলছে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার প্রশ্নে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তানের চার পাশের দেশগুলি যে ভাবে তাদের সন্ত্রাসের কারখানা নিয়ে উদ্বিগ্ন, এ ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি সেই দিকে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় আসার পরে এক মাস হতে চলেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার, আইন শৃঙ্খলা ঠিক জায়গায় আনা, বাণিজ্যিক ক্রিয়াকলাপ পুনরুদ্ধার করা প্রয়োজন। কিন্তু তারা ব্যস্ত আওয়ামী লীগের নেতা ও সমর্থকদের খুঁজে বের করতে।
বিশেষজ্ঞদের মত, আন্তর্জাতিক স্তরে আস্থা ফিরে পাওয়ার জন্য শিল্প, বাণিজ্য, অর্থনীতি নিয়ে একটি নির্ভরযোগ্য পাকাপোক্ত নীতি নিতে হবে এই সরকারকে। স্পষ্ট বিদেশনীতি তৈরি করে তা জানাতে হবে। কারণ অনেক বিদেশি রাষ্ট্রের বাণিজ্যিক স্বার্থ জড়িয়ে রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে।
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ভারতের ওপর নির্ভরশীল ঢাকা। কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিৎ নিজের দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে অবিলম্বে নয়াদিল্লির সঙ্গে কথোপকথন শুরু করা।
প্রতিবেদনে টানা হয়, শ্রীলঙ্কার প্রসঙ্গও। বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কাও এই ধরনের সঙ্কটে পড়েছিল এবং দিল্লির পাশে থাকা তখন কলম্বোর জন্য অত্যবশ্যক ছিল। ভারতই সর্বাগ্রে এবং একমাত্র দেশ হিসেবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কার দিকে। ভারতের প্রতি ‘লক্ষ্যহীন ক্রোধ’ এবং ‘অন্যায় বিরোধিতা’ করে গেলে তা ভারত-বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ সম্পর্ককেই দুর্বল করবে। বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থের জন্যও এই নীতি ভাল নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজের সব রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়কে সরকার ও প্রশাসনের অংশ করা উচিত বলেও উল্লেখ করেছে প্রতিবেদনটি।
শেরপুরে গত মাসের ৬ আগস্ট থানায় হামলা, ৫০০ জন অপরাধীর পালানোর মতো ঘটনাগুলি তুলে ধরে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রবণতা বিপজ্জনক। যে হিসাব ভারতের কাছে রয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে নৈরাজ্য এবং আইনহীনতার চূড়ান্ত পরিস্থিতি চলছে বাংলাদেশে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষকে পদত্যাগ করানো হয়েছে। ১৭৫টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে পদত্যাগ করানো হয়েছে। জোর করে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্টের বিচারপতিদের, যার মধ্যে রয়েছেন প্রধান বিচারপতি এবং অ্যাটর্নি জেনারেল-ও। ফেরত পাঠানো হয়েছে ১১ জন রাষ্ট্রদূত, সরানো হয়েছে আগের সরকারের ৩৩ জন স্থায়ী এবং ৩০০ জন সহ-সচিবকে।
এছাড়াও ১৮০টি মামলা দায়ের করে জড়ানো হয়েছে দু’লক্ষ আওয়ামী লীগ কর্মীকে। আওয়ামী লীগের অনেক নেতা গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে আত্মগোপনে আছেন। ১০০টির উপর বস্ত্র কারখানা বন্ধ রয়েছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য।
সংবাদমাধ্যমকে কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বলে দাবি করা হয়েছে প্রতিবেদনটিতে। বলা হয়েছে, অনেক বেসরকারি টিভি চ্যানেল বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশে। অনেক সম্পাদক এবং সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে, অনেকে প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে রয়েছেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলে কিছু নেই।
সব মিলিয়ে ভারতীয় রণনৈতিক বিশেষজ্ঞরা, বাংলাদেশ পরিস্থিতিকে ‘জঙ্গলের রাজত্ব’ হিসেবে অভিহিত করতে চেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছে সংবাদমাধ্যমটি।