৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পুরোপুরি অচল ছিল রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। সেই দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীরা। সেসময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ পথে পথে চোঁখে পড়েছে সুসঙ্খল গণপরিবহন। বন্ধ ছিল উল্টো পথে যানবাহন চলাচল।
অসম্ভবকে সম্ভব করে রাজধানীর বিভিন্ন স্টপেজে নির্দিষ্ট জায়গায় চলেছে যাত্রী ওঠানামা। অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল ওভারটেকিং। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে লাইন করে সুসৃঙ্খলভাবে দাঁড়ানো বাইকার-রিকসা। এমনকি অলিগলির রাস্তাতেও লাইন মেনে যাত্রীদের অপেক্ষায় ছিল অটো রিকসা। সেই ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর ২০২৪-এ শিক্ষার্থীরা আবারও চোঁখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় চাইলেই সম্ভব। কিভাবে নিয়ম মেনে চলে পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। এর মধ্যে নানা অসঙ্গতি থাকলেও-প্রশিক্ষিত ট্রাফিক পুলিশের অনুপস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের এমন সফল কাযর্ক্রম প্রসংশা কুড়িয়েছে সারাদেশে।
শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিক কারনেই সরে গেছে রাস্তা থেকে। ট্রাফিকের দায়িত্বে ধীরে ধীরে ফিরেছে পুলিশ। আবার যেই লাউ সেই কদু। রাজধানীতে সেই চিরচেনা বিসৃঙ্খল গণপরিবহন। যেখানে সেখানে চলছে যাত্রী ওঠানামা, পুরো রাস্তাজুড়েই যেন বাস স্টপেজ। বিভিন্ন স্থাণে আবার উল্টো পথের যাত্রা, ওভারটেকিং। নিয়মের যেন কোন বালাই নেই। সবমিলিয়ে হ য ব র ল অবস্থা। নিয়ন্ত্রণহীন যানবাহনের চলাচলে অসহনীয় যানজটে নাকাল ২ কোটি জনসংখ্যার ভারে নুজ্য রাজধানী ঢাকা।
কিন্তু এসবের সমাধান আসলে কি? মজার ব্যাপার হলো-সমাধান কিন্তু সবারই জানা। জেনেশুনে কেউ সমাধানের দিকে আমরা হাটছি না। বাসকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনা গেলে রাজধানীর রাস্তার চিত্র পুরোপুরি বদলে ফেলা সম্ভব। সেই বাসকেই স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও নিয়মের মধ্যে আনতে পারেনি কোন সরকার। সবশেষ আশার আলো জ্বালিয়েছিলেন-ঢাকা উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আনিসুল হক। ২০১৫ সালের ২৮ এপ্রিল তিনি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরবাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি প্রকল্পের মাধ্যমে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন ঢাকাবাসীকে। বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি হলো বিশ্বের জনবহুল শহরগুলোয় সবচেয়ে সফল বাস ব্যবস্থাপনা। যেখানে এক রুটে চলে এক কোম্পানির বাস। দিন শেষে ওই রুটের মোট আয় ভাগ করে দেয়া হয় ওই পথে চলা সব বাসের মধ্যে। সব বাস মালিক পায় সমান টাকা। ফলে বাসে বাসে প্রতিযোগিতা থাকে না। কাউন্টারে খুব বেশি সময় না দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান যাত্রীদের নিয়েই অবিরাম ছুটে চলে বাস। সবমিলিয়ে সারা দুনিয়ায় পরীক্ষিত এই বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ঢাকায় হতে হতে হলো না।
ঢাকার প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের হাত ধরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল ঢাকাবাসী। বাস মালিকদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে তাদেরকে বোঝাতেও সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। পরিকল্পনা ছিল-ঢাকায় চলার কথা ছিল ঢাকার রুটগুলো বিন্যাস করে ২২টি রুট করা হবে। আর এসব রুটে চলবে ৬ কোম্পানির ভিন্ন ভিন্ন রংয়ের বাস। কেনার কথা ছিল চার হাজার নতুন বাস। ধীরে ধীরে উঠিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল ঢাকার রাস্তার জরাজীর্ন সব বাস। কম সুদে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাস মালিকদের জন্য ঋণের ব্যবস্থাও এগিয়েছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে ডিসেম্বরে আনিসুল হকের অকাল মৃত্যুতে বাসের সুদিনের স্বপ্নও যেন থমকে যায়।
পরবর্তীতে মেয়র সাঈদ খোকন দায়িত্ব নেন আনিসুল হকের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। বলেছিলেন-দুই বছরের মধ্যে বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রোগ্রাম আলোর মুখ দেখবে। সেই দুই বছর যেন শেষ হয়নি এখনও। পরবর্তীতে উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং দক্ষিনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ঢাকার বাসকে শৃঙ্খলায় ফেরানোর উদ্যোগ নেন। সিদ্ধান্ত হয়-ঢাকায় ৪২ রুটে চলবে ২২ কোম্পানির বাস। কিন্তু সেই স্বপ্নও অধরা। শেষেমেষ জোড়াতালি দিয়ে চালু হয় ঘাটারচর থেকে মতিঝিল পযর্ন্ত রুটে ঢাকা নগর পরিবহন। নানা অব্যবস্থাপনায় তাও হয়ে যায় বন্ধ।
গণপরিবহন নিয়ে যত রিপোর্ট করেছি-সেখানে বিশেষজ্ঞরা বারবার বলেছেন-রাজনৈতিক কঠোর সিদ্ধান্ত ছাড়া ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরার সুযোগ নেই। কিন্তু সেই শক্ত সিদ্ধান্ত আসেনি সরকারের পক্ষ থেকে। যেকারনে সমাধানের সব রকম পরিকল্পনা প্রস্তুত থাকলেও বারবার হোঁচট খেয়েছে বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রোগ্রাম। পত্রিকার পাতায় বড় বড় শিরোনামের খবরে অভিযোগ-সিন্ডিকেট-চাঁদাবাজি এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বড় বাধা। যেখানে যখন যে দল ক্ষমতায় থেকেছে, তারাই নিয়ন্ত্রণ করেছে বিশাল এই পরিবহন খাত। আর নিদারুন কষ্টে পথে চলেন রাজধানীবাসী। দিনকে দিন কমে গেছে বাসের গতি। জরাজীর্ন লক্করঝক্কর হয়েছে ঢাকার বাস। যে গণপরিবহনের ওপর নির্ভরশীল রাজধানীর ৭০ ভাগের বেশি মানুষ। আক্ষেপ হয়-ঢাকায় সবকিছু বদলায়, শুধু বদলায় না বাস।
ছাত্র-জনতার হাত ধরে নতুন বাংলাদেশের পথচলা শুরু। এখনই বড় সুযোগ আনিসুল হকের স্বপ্নের বাস রুট রেশনালাইজেশন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের। কারন রাজনৈতিক সরকারের জন্য অনেকটা দূরহ কাজ হবে গণপরিবহনকে শৃঙ্খলায় ফেরানো। অনেক কঠিন হবে সিন্ডিকেট-চাঁদাবাজিমুক্ত গণপরিবহন খাত উপহার দেয়া। তাই নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা থাকছে-ঢাকায় বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রোগ্রাম বাস্তবায়নের। যেখানে রুট, কোম্পানি, বাস স্ট্যান্ড, টার্মিনাল সবকিছুই কাগজে কলমে প্রস্তুত, দরকার শুধু শুভ উদ্যোগের। একজন সাংবাদিক বাসযাত্রী হিসেবে অপেক্ষায় রইলাম।