আজ ৫ সেপ্টেম্বর, স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের এক মাস। গত মাসের এ দিনটা শুরু হয় উৎকণ্ঠা ও একইসঙ্গে নতুন স্বপ্ন নিয়ে। আগের দিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা একদিন এগিয়ে ৬ আগস্টের পরিবর্তনে ৫ আগস্ট লংমার্চ ডাকে। জাতীয় কোনো নেতা না হলেও তাদের ডাকে সাড়া দেয় দেশের আপামর জনগণ।
এরপরের গল্পটা তো সবারই জানা।
৫ আগস্টের সকালে ছিল গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। শাহবাগকে কেন্দ্র করে মোতায়েন করা হয় ব্যাপক পুলিশ। ঢাকায় ঢোকার মোড়ে মোড়ে অবস্থান নেন তারা। ছিল সেনাবাহিনীও। সকালে রাস্তায় মানুষই জড়ো হতে পারেনি পুলিশের কারণে। ছোড়া হয় টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড। তাতেও যখন দমানো যাচ্ছিল না, তখনই ফের বন্ধ করে দেওয়া হয় ইন্টারনেট।
জুলাইতে ইন্টারনেট বন্ধ রেখে ছাত্র-জনতার আন্দোলন রুখে দেওয়ার পায়তারা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এবারও তাদের পরিকল্পনা ছিল একই। এবার অবশ্য কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসেনি। সময় যত গড়াতে থাকে, বদলাতে থাকে পরিস্থিতি। দুপুর ১২টা নাগাদ কারফিউ ভেঙে লাখো মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। সেখান থেকে বাদ যায়নি বৃদ্ধ এমনকি শিশুরাও। এক পর্যায়ে শাহবাগ, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারসহ গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে।ঢাকায় ঢোকার বিভিন্ন পয়েন্টে একটা সময় পুলিশ বাধা দিলেও, জনতার চাপে একটা সময় পিছু হটে তারা। তবে এসময় ঢাকার যাত্রাবাড়ীসহ আরও বেশ কয়েকটি জায়গায় পুলিশ অতর্কিত গুলি চালায়। অনেকে নিহতও হন। এরপর আর জনতার চাপ সামাল দিতে পারেনি তারা। সেনাবাহিনীও ছাত্র-জনতার পথের কাটা হয়নি। ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি তখন সফল হওয়ার পথে। অনেকে যাত্রা শুরু করলেন গণভবনের দিকে।
এরপরই ঘোষণা আসে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান দুপুর ২টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ওই সময় পর্যন্ত সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানান তিনি। পরে দুই দফায় তার ভাষণের সময় পেছানো হয়। কিন্তু ততক্ষণে লেখা হয়ে যায় শেখ হাসিনা শাসনের এপিটাফ।
দুপুর থেকেই কানাঘুষো পদত্যাগ করছেন শেখ হাসিনা। সেই খবর সত্যি হতে বেশি সময়ও লাগলো না। দুপুর ২টা নাগাদ চালু হয় ইন্টারনেট। আর তিনটার আগেই বিশ্বের বড় কিছু গণমাধ্যম জানালো, পদত্যাগ করে একটি সামরিক হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন তার ছোট বোন শেখ রেহানা।
হাসিনার টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলের ইতি ঘটার সংবাদে আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো গোটা দেশে। সেদিন যারা কখনো আন্দোলনে নামতে পারেননি নানা কারণে, তারাও বের হয়ে এলেন ঘর থেকে। আনন্দ-উৎসবে মেতে ওঠে গোটা দেশ।
বিকেলে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন সেনাপ্রধান। ওয়াকার-উজ-জামান জানালেন, প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। তিনি আরও বলেন, এখন রাজনৈতিক ক্রান্তিকাল চলছে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হবে। সব হত্যার বিচার হবে। সেনাবাহিনীর ওপর আস্থা রাখেন। আমরা রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি।
জনগণের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বলেন, ‘দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখেন। আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখেন, একসাথে কাজ করি। দয়া করে সাহায্য করেন। মারামারি সংঘাত করে আর কিছু পাব না।তবে সেনাপ্রধানের এ ঘোষণা আসার আগেই গণভবন দখলে নেয় ছাত্র-জনতা। পরে জানা যায়, হাসিনা দেশ ছাড়ার পর গণভবন ছাড়তে মাত্র ৫ মিনিট সময় পেয়েছিল নিরাপত্তা বাহিনীরা। তারা গণভবন ছাড়তেই মূলত সেখানে ঢুকে পড়ে আম-জনতা। সেখানে কাউকে দেখা যায়, পুকুরে সাঁতার কাটতে, কাউকে মাছ শিকার করতে, কাউকে আবার বুফে খেতে।
অনেকে গণভবনের ভেতর ঢুকে রাখা খাটে শুয়ে ছিলেন। অনেকে আবার চালান লুটপাট। প্রায় একই দৃশ্য দেখা যায় সংসদ ভবনে। সেখানেও ঢুকে পড়ে অনেক ছাত্রজনতা।
হাসিনার পলায়নের পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে দীর্ঘদিনের শোষণ-বঞ্চনার বদলা নিতে শুরু করেন অনেকেই। সারাদেশজুড়ে শুরু হয় হামলা-ভাঙচুর। যার বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মী বাড়িঘর ও কার্যালয়ে।
আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতাদের বাড়িঘরে হামলার পর অনেকের বাড়ি পুড়িয়েও দেওয়া হয়। হামলা হয় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। ৬ ঘণ্টার জন্য বন্ধও থাকে বিমানবন্দরের সমস্ত কার্যক্রম। এছাড়া ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জাদুঘরে আগুন, সুধাসদন, সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়িতে হামলা, তৎকালীন প্রধান বিচারপতির বাড়িসহ অসংখ্য জায়গায় হামলা-ভাঙচুর হয়। এছাড়া হামলা হয় একাধিক গণমাধ্যমেও। সন্ধ্যা হতেই যার মাত্রা আরও বাড়তে থাকে।তবে অন্যদিকে, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কার্যক্রমও চলতে থাকে। রাতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তখন খোঁজা হচ্ছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদেরও। তবে সে সময় তাদের পাওয়া যায়নি। পরে সেনাপ্রধান জানান, শিগগিরই ছাত্র-শিক্ষক প্রতিনিধির সঙ্গে বসবেন তিনি।
দেশে সেদিন স্বৈরাচার পতনে যেমন উৎসব করেছে মানুষ, তেমনি ঘটেছে অপ্রীতিকর অনেক ঘটনাও। তবে স্বৈরাচারী সরকার নেই, দিনশেষে এই খুশিই সেদিন যেন মুখ্য হয়ে উঠেছিল সবার কাছে।