নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করার জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সব ক্ষেত্রেই সমতা আনতে হবে। নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে ১৯৭৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কনভেনশনটি কার্যকারিতা লাভ করে। নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন সবচেয়ে ব্যাপক ও আইনগতভাবে অবশ্যপালনীয় মানবাধিকার।
এরই ভিত্তিতে প্রতি বছর ৩ সেপ্টেম্বর নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ, বা সিডও সনদ দিবস পালন করা হয়। নারীর প্রতি চলমান এই বৈষম্যগুলো দূর করা সেদিনই সম্ভব হবে, যেদিন আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন হবে এবং নারীকে পুরুষের সমতায় এনে সম্মান দিতে শিখব।
কনভেনশনের শর্তানুযায়ী রাষ্ট্রপক্ষের প্রতি নারীর মৌলিক মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, নারী পাচার ও পতিতাবৃত্তিতে নারীর শোষণ রোধ নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক ও লোকজীবনে নারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান, জাতীয়তা অর্জন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক ও সমাজজীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে বৈষম্যের অবসান ঘটাতে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। রাষ্ট্রপক্ষ এই শর্তাবলি মেনে চলে কি না, তা পরীক্ষণের জন্য ২৩ সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি রয়েছে, যাকে বলা হয় ‘কনভেনশন অন দ্য এলিমিনেশন অব অল ফর্মস অব ডিসক্রিমিনেশন অ্যাগেইনস্ট উইমেন (সিইডিএডব্লিউ-সিডও)’।
প্রতিবছরই দিবসটিতে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে সবাইকে মনে করিয়ে দেয়া হয়Ñনারীর প্রতি বৈষম্যের অবসান ঘটানো উচিত। তবে নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদে যে নীতিগুলো রয়েছে, তার বাস্তবায়ন এখনও আমরা সম্পূর্ণভাবে দেখতে পাই না। এই দিবসটি পালন করার সময় আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, নারীর অধিকার রক্ষা শুধু বছরের এই একটি দিনের জন্য নয়, সেটা এখন প্রতিদিনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোথাও না কোথাও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে নারী। নারী অধিকার নিয়ে লড়াই থেমে যায় সমাজ ও আশেপাশের মানুষের নেতিবাচক মনোভাবের জন্য। নারী-পুরুষের মধ্যে বিভেদ নিতান্তই মানবসৃষ্ট। তাহলে আমরা কেন সবাই একত্র হয়ে মানবসৃষ্ট এই নিয়মগুলোকে ভাঙতে পারি না। কেনই বা নারীদের গর্বের সঙ্গে বলতে পারি নাÑ‘তোমাদের জন্য এই সমাজ নিরাপদ, তোমরাও রাষ্ট্রের কাছে পুরুষের সমমানের। ’
নারী অধিকার নিয়ে যুগে যুগে অনেকেই আন্দোলন করে গেছেন। তারা শুধু নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেনÑ‘নারীরাও পারে। ’
শতাব্দীব্যাপী নারী আন্দোলনের অভিযাত্রা ও বিংশ শতাব্দীর মানবাধিকার আন্দোলনের অনুকূল পরিবেশে জাতিসংঘ নারী আন্দোলনের অগ্রগতির নানা উদ্যোগের ফসল ‘সিডও সনদ’।
স্বাধীনতার এত বছর পেরিয়ে আমরা উন্নয়নের পথে আরোহণ করেছি। বর্তমানে আমাদের সমাজে নারীর অবস্থা আগের থেকে অনেক উন্নত। তবুও কিছু বাধা নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে চলেছে প্রতিনিয়ত। এই বৈষম্য যেন আবার সেই পুরোনো দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয়, যখন নারীর ছিল না কোনো অধিকার, কোনো সম্মান। একটা দেশকে সমানভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা থাকা প্রয়োজন।
পুরুষের অধিকার নিয়ে তো সেই আশির দশক থেকে লড়াই করতে হয়নি! তাহলে কেন নারীর জন্য বারবার আন্দোলনের ঝড় তুলতে হয়? তাদের অধিকার কেন চেয়ে আদায় করতে হয়?
তবে আজ যখন বর্তমান নারী সমাজকে দেখি, তখন মনে হয় সমাজে বৈষম্য থাকা সত্ত্বেও তারা দমে যাচ্ছে না, বরং দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছে। বর্তমানে এমন কোনো চাকরির ক্ষেত্র নেই যেখানে নারী সম্মান ও অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি, পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে চলেছে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এমন অনেক সাফল্যের কথা আজ ইতিহাসে লেখা হয়েছে নারীদের নিয়ে, তাদের সাহসিকতাকে সম্মাননা জানানো হয়েছে, তবুও সমাজের কিছু মানুষ আছে যারা এই উন্নয়নকে আড়াল করে নারীর পায়ে শিকল দিয়ে দাবিয়ে রাখতে চায়। তাদের কাছে নারীর উন্নয়ন মানে আলাদা একটা জগৎ। তারা ভাবতেই পারে না, নারীও পুরুষের মতো সমানভাবে এগিয়ে যেতে পারে। নারীর প্রতি সহিংসতার একটি বড় কারণ তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে শুধু পুরুষের অধস্তন হিসেবে নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় নারীকে। সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছ থেকে নারীর প্রতি এমন আচরণ কোনোভাবেই কাম্য নয়। সিডও সনদে নারীর অধিকার ও সম্মান এগুলোর কথা খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে।
সিডও সনদের ৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, পুরুষ ও নারীর মধ্যে কেউ উৎকৃষ্ট এই ধারণার ভিত্তিতে কিংবা পুরুষ নারীর চিরাচরিত ভূমিকার ভিত্তিতে যেসব কুসংস্কার, প্রথা ও অভ্যাস গড়ে উঠেছে, সেগুলো দূর করার লক্ষ্যে পুরুষ ও নারীর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আচরণের ধরন পরিবর্তন করতে হবে।
তবে নারীর জন্য এই অবস্থান তৈরি করা খুব সহজ বিষয় নয়। তৃণমূল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। যখনই দেখা যায়, জনসাধারণ নারীর অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়, তখন রাষ্ট্রের মধ্যে কর্মসূচি পালনে অনীহা দেখা দেয়। আবার যখন রাষ্ট্র কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করে, তখন মানুষের মধ্যে নীতিমালাগুলো মান্য করার কোনো বাধ্যবাধকতা দেখা যায় না। নারী যে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে জীবন অতিবাহিত করছে, সেটা তাদের প্রাপ্য নয়। তাদের স্থায়ী জীবন দান করা আমাদের সবার কর্তব্য। নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনায় বিচার পাওয়া প্রায় অসম্ভব। বারবার বিচারহীনতায় অপরাধীরা পাড় পেয়ে যায়, আর সেই সংশয় নিয়ে দিন কাটাতে হয় নারীকে। বিচারহীনতার এই সংস্কৃতি বাংলাদেশকে অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য করে তুলছে। যদিও সিডও সনদের মাধ্যমে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ যে, আইনের সব সুযোগ নারীকে দিতে হবে। বিচারহীনতার এই দেশে অন্য অনেক অধিকারের সঙ্গে বিচার লাভের সুযোগ থেকেও নারী বঞ্চিত। সিডও সনদে নারীকে নিয়ে যেসব অধিকারের কথা বলা হয়েছে, যদি সেগুলোর বাস্তবায়ন ঘটানো হয়, তাহলে নারীকে আর দমিয়ে রাখা যাবে না। সমাজ থেকে সৃষ্ট বৈষম্যগুলো নারীকে আর আহত করতে পারবে না। কিন্তু নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে, সেই পার্থক্যের কারণেই নারীদের প্রতি এত বৈষম্য। তাদের সমস্যার কোনো স্থায়ী সমাধান নেই। সমাজের ভিত কাঁপিয়ে দেয়ার মতো পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনাও আমাদের বিবেককে নাড়া দেয় না। একটা ঘটনার সূত্রপাতে চাপা পড়ে যায় আরেকটি ঘটনা।
নারীসমাজের সার্থকতা নেই শুধু বৈষম্যগুলোর জন্য। তবে আমরা চাইলেই পারি বৈষম্যগুলোকে ভেদ করে সুস্থ সুন্দর সমাজ গড়তে, যেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না। ‘সিডও’ সনদের নীতিমালা অনুযায়ী এমন সমাজ নারীর জন্য কাম্য, যেখানে নারীকে কেউ উচ্চ স্বরে দাবিয়ে রাখবে না। নারীবান্ধব, উদার ও সংস্কারমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করা হয়েছে সিডও সনদে। সিডও সনদ দিবসে এই প্রতিটি কথাকে স্মরণ করে প্রতিটি আইনের প্রয়োগ ঘটাতে হবে।