নকল হীরা বিক্রিতে উন্নতমানের কাচের টুকরো ব্যবহার নিয়ে আলোচিত ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালার ভেজাল মদে সর্বনাশের শিকার হচ্ছেন লাখো মানুষ। আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য কমিটির সদস্য দিলীপের মদ বিক্রির কোম্পানি গুলশানের সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড বা এসটিএল।
এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড -এনবিআরের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট সূত্র বলছে, এসটিএল কূটনৈতিকদের ব্যবহারের জন্য আনা বন্ডেডওয়্যার হাউস সুবিধার মদ কালোবাজারে বিক্রি করে বিগত সাত বছরে সরকারের প্রায় ২৮৩ কোটি টাকা শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। এদিকে দেশে বন্ড সুবিধার মদে ভেজাল দিয়ে কালোবাজারে বিক্রি করায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা।
ভেজাল ও নিম্নমানের মদ পানে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র বলছে, মদ বিক্রির কোম্পানি সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড বা এসটিএলে চট্টগ্রামভিত্তিক বৃহৎ ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সঙ্গে পার্টনার ছিলেন এমপি আনার হত্যাকাণ্ডে আলোচিত সোনা ও হীরা চোরাকারবারির ডনখ্যাত দিলীপ কুমার আগরওয়ালা।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ক্ষমতার পালাবদলে আওয়ামী লীগ থেকে বিএনপিপন্থি হয়ে ওঠে দিলীপ কুমার আগরওয়ালা। এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ৭৫ শতাংশ শেয়ার থাকার পরও, মাত্র ২৫ শতাংশ শেয়ারের মালিক হয়ে দিলীপ রাতের আঁধারে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন পুরো সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে কয়েক শ কোটি টাকার শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা মদের মজুদ রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে দিলীপের মদের কোম্পানি সাবের ট্রেডার্সে এনবিআরের নজরদারি বাড়ানোর হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। এদিকে চলতি বছরের ২০ জুন রাজধানীর নয়াপল্টনের একটি অফিসকক্ষ থেকে ফরহাদ (২১) ও ইমন (২৩) নামে দুই তরুণের লাশ উদ্ধার করে পল্টন থানা পুলিশ। এই দুজন বিষাক্ত মদ পানের কারণে মারা যেতে পারেন বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করে পুলিশ। এর আগে চলতি বছরের ১১ এপ্রিল নওগাঁর মান্দায় বিষাক্ত মদপানের পর অসুস্থ তিন যুবকের মৃত্যু হয়েছে। মৃত যুবকরা হলেন- উপজেলার ভারশো ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের আক্কাস আলীর ছেলে শারিকুল ইসলাম পিন্টু (২২), পাকুড়িয়া মধ্যপাড়া গ্রামের আবদুর রশিদের ছেলে আশিক হোসেন (২২) ও প্রসাদপুর ইউনিয়নের দারিয়াপুর গ্রামের নেকবর আলীর ছেলে নাঈমুর রহমান নিশাত (২০)।
সম্প্রতি বেসরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধের (মানস) এক হিসেব মতে, দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে ১ কোটি মাদকাসক্ত এবং বাকি ৫০ লাখ মাঝেমধ্যে মাদক সেবন করে। সেই হিসেবে দেশের প্রায় ১৭ কোটি ১৫ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে গড়ে প্রতি ১২ জনে (১১ দশমিক ৬৭) একজন মাদকসেবী। শতাংশের হিসাবে মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ মাদকসেবী।
মাদক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করায় বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া সহজলভ্য হয়ে উঠছে যেকোনো মাদক। ফলে দিন দিন বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মনে করছে, সাম্প্রতিক সময়ে নতুন পথে নতুন মাদকের অনুপ্রবেশ আরও বেশি আসক্ত করে তুলছে তরুণ ও যুবকদের। পাশাপাশি পূর্ণবয়স্ক এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যেও মাদকাসক্তি আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ থেকে ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত মাদকাসক্ত হয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে (রিহ্যাব) চিকিৎসা নিতে গেছে অন্তত ৫০ হাজার মাদকসেবী। আর গত পাঁচ বছরে রিহ্যাবে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মাদকাসক্ত নারীর সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ গুণ। ১৫ ও তার কম বয়সী মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ।
মানসের চেয়ারম্যান ও জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের উপদেষ্টা সদস্য অধ্যাপক ডা. অরূপ রতন চৌধুরীর মতে- মাদক হলো সব অপরাধের জনক।
খুন, ধর্ষণ, পারিবারিক কলহ থেকে শুরু করে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনার বেশির ভাগ ঘটছে মাদকের কারণে।
এনবিআর সূত্র বলছে, বর্তমানে সারা দেশে দেড় শতাধিক লাইসেন্স পাওয়া মদের বার রয়েছে। যার ৮০ শতাংশ রাজধানীতে। এ ছাড়া বন্ড সুবিধায় আসা মদ কূটনৈতিক ব্যক্তিত্বরা (প্রিভিলেজড পারসন) বেশি কেনেন। আমাদের কাছে বিভিন্ন সময়ে তথ্য এসেছে, তারা ওই মদের একটি অংশ বাইরে বিক্রি করে দেন। এ ছাড়া মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি, চোরাইপথেও মদ আসে। এসব মদ সরাসরি যায় দিলীপের মদ বিক্রির কোম্পানি সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড বা এসটিএলে। এনআর সূত্র জানায়, বন্ড সুবিধায় দেশে ছয় ধরনের মদ বা অ্যালকোহল-জাতীয় পানীয় বাংলাদেশে আসে। আমদানি করা মদের মধ্যে রয়েছে- বিয়ার, স্পিরিটজাতীয় পানীয়, হুইস্কি, রাম ও টাফিয়া, গিন ও জেনিভা, ভদকা, লিকারস ও করডিয়ালস।
এনবিআরের অধীন কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিস শুল্কমুক্ত সুবিধার আওতায় থাকা ছয়টি বারে মদের আমদানি ও সরবরাহ দেখভাল করে। এগুলো হলো- সাবের ট্রেডার্স লিমিটেড, ইস্টার্ন ডিপ্লোম্যাটিক সার্ভিসেস, টস বন্ড, ন্যাশনাল ওয়্যারহাউজ, ঢাকা ওয়্যারহাউজ ও এইচ কবির অ্যান্ড কোম্পানি। এর মধ্যে পাঁচটি গুলশানে এবং একটি মহাখালীতে অবস্থিত। ঢাকা কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিসের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রিভিলেজড পারসনদের শুল্কমুক্ত সুবিধার সনদ দিয়ে থাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
অভিযোগ রয়েছে, অতীতে বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধাপ্রাপ্ত বারগুলো বিপুল পরিমাণ শুল্কমুক্ত মদ এনে বাইরে বিক্রি করে দিত। এতে বারগুলো লাভবান হলেও সরকার বিপুল অঙ্কের রাজস্ব হারাত। এ খাতে শৃঙ্খলা আনতে ২০১৭ সালে ছয়টি বন্ডেড ওয়্যারহাউজে মদ আমদানি, তা বিক্রির পাস বই সংরক্ষণ; ক্রেতার শুল্কমুক্ত সুবিধার সনদ দেখানো এবং কোন ব্র্যান্ডের কতটুকু বিক্রি হলো তা প্রতি মাসে পাঠানোর বাধ্যবাধকতা আরোপ করে। তবে শুরুর দিকে তা পরিপালন না হলেও সাম্প্রতিক সময়ে নীরবতা ভেঙেছে এনবিআর।
এনবিআরের কাস্টমস বন্ড কমিশনারেট অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, একজন প্রিভিলেজড পারসন বছরে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মদ শুল্কমুক্ত সুবিধায় গ্রহণ করতে পারেন। এখন প্রতিটি বিক্রির বিপরীতে পাস বইয়ের কপি ও শুল্কমুক্ত সুবিধার কপি জমা নেওয়া হচ্ছে প্রতি মাসে। ফলে অনিয়ম করে বাড়তি আমদানির সুযোগ কমে গেছে।