মেঘলা আবহাওয়াতেও বাইরের আলোয় চোখ মেলতে কষ্ট হচ্ছিল মানুষটার। টানা পাঁচ বছরের বেশি সময় সূর্যের মুখ দেখার সুযোগ হয়নি তার। প্রায় অর্ধ যুগ সময় ধরে বন্দী ছিলেন এক বদ্ধ ঘরে, যে ঘরে দিনের আলো ঢোকার অনুমতি ছিল না। কম পাওয়ারের বাল্ব, প্রচন্ড ফ্যানের শব্দ আর তা ছাপিয়ে অন্য বন্দীদের আর্তনাদ ছিল তার প্রতিদিনের সঙ্গী।
মাইকেল চাকমাকে ২০১৯ সালে অপহরণ করা হয়, তারপর তার জায়গা হয় বাংলাদেশের কুখ্যাত আয়না ঘরে। পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বন্দি থাকার পর যখন তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় ততদিনে তার পরিবার তাকে মৃত ভেবে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করে ফেলেছেন। ঢাকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাইকেল মনে করতে পারছিলেন না তার বোনের নাম্বারও।
গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই আয়না ঘরের বন্দিদের মুক্তি দেওয়া শুরু হয়।
বন্দিদের মুক্তির খবর দেখে ঢাকা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে বসে মাইকেলের বোন ভাবছিলেন তার ভাইও কি আছেন এই বন্দিদের মধ্যে।
২০১৯ সালের এপ্রিলে যেদিন মাইকেল চাকমাকে জোরপূর্বক চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়,তিনি ভেবেছিলেন এটাই শেষ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলের জনগণের অধিকারের জন্য বছরের পর বছর প্রচারণা চালানোর পর তিনি কর্তৃপক্ষের নজরে আসেন। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতে, তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক বাহিনীর দ্বারা সংঘটিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সোচ্চার ছিলেন এবং এই অঞ্চলে সামরিক শাসনের অবসানের জন্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন।
মাইকেলকে অপহরণের একদিন পর, তাকে রাজধানী ঢাকায় ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স (ডিজিএফআই) কম্পাউন্ডের ভিতরে লুকানো ভবন আয়না ঘরের ভিতরে একটি কক্ষে রাখা হয়।
তিনি বলেছিলেন যে ছোট ঘরটিতে তাকে রাখা হয়েছিল, সেখানে কোনও জানালা ছিল না এবং সূর্যের আলো ছিল না, কেবল দুটি প্রচুর শব্দ করা ফ্যান ছিল।
ওই ঘরে কিছুক্ষণ পরে আপনি সময় এবং দিনের বোধ হারিয়ে ফেলবেন বলে জানান মাইকেল। তিনি বলেন, “আমি অন্যান্য বন্দীদের কান্না শুনতে পেতাম, যদিও আমি তাদের দেখতে পেতাম না, তাদের চিৎকার ছিল ভয়ঙ্কর। “
তিনি আরও বলেন, “তারা আমাকে একটা চেয়ারে বেঁধে খুব দ্রুত ঘোরাতেন। প্রায়ই, আমাকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করার হুমকি দেওয়া হত। তারা জিজ্ঞেস করেছিল আমি কেন হাসিনার সমালোচনা করছি। “
বাংলাদেশের মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা নির্বাচিত হওয়ার বছর থেকে ৬০০ টি বলপূর্বক গুমের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে।
পরবর্তী বছরগুলিতে, শেখ হাসিনার সরকার তাদের শাসনের জন্য হুমকিস্বরূপ যে কোনও ভিন্নমতকে স্তব্ধ করার প্রয়াসে তাদের সমালোচক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের টার্গেট করেছে। অবশ্য তিনি এবং তার সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
তথাকথিত নিখোঁজদের মধ্যে কয়েকজনকে অবশেষে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বা আদালতে হাজির করা হয়েছে, অন্যদের মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, প্রায় ১০০ জন এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।