কিছু অদ্ভুত গল্প চালু আছে শিশু রুমিকে নিয়ে। একেবারে বাল্যকালের সেই সব গল্প। রুমির বাবা বাহা ভালাদ-এর জবানীতেই কাহিনীগুলো পাওয়া যায়।
অদ্ভুতূরে এই গল্পগুলোর কথা বিস্তারিত লিখেছেন ব্রাড গুচ, তাঁর ‘রুমি’স সিক্রেট’ গ্রন্থে।
রুমির ‘শূন্যে হাওয়া হয়ে যাওয়া’র কাহিনীটাই আগে বলি।
রুমির বয়স তখন পাঁচ কি ছয়। প্রতিবেশী শিশুরা একদিন রুমির বাড়ি এলো। অন্যান্য সময়, মাঝে-মধ্যে যেমন আসে, তেমনি আরকি। সেদিন ছিলো শুক্রবার সকাল। শিশুরা সবাই ছাদের উপর খেলা, গল্প আর দুষ্টুমিতে মশগুল।
তেমন সময় রুমির এক বন্ধু বলে উঠলো, ‘চলো, আমরা লাফিয়ে এই ছাদ থেকে অন্য ছাদে যাই’।
এই প্রস্তাব নিয়ে শিশুদলের মধ্যে একটা শোরগোল আর উত্তেজনার আবহ দেখা দিলো। লাফিয়ে ছাদ পাড় হওয়া নিয়ে কেউ কেউ বাজি ধরে বসলো। অন্য আরো দু’-একজনের মতন রুমিও এই প্রস্তাবের দিকে খানিকটা যেনো হেসে উড়িয়ে দেয়ার ভাব করলো।
এই সব বাৎ-চিৎ যখন চলছে, তারই মধ্যে সবার সামনে থেকে হঠাৎ রুমি অদৃশ্য হয়ে গেলো। এই ঘটনা দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় শিশুদের দলে শুরু হলো কোলাহল। তবে, অদৃশ্য হবার মিনিট কয়েকের মধ্যেই সে আবার আবির্ভূত হলো।
পূনরায় দৃশ্যমান হবার পর রুমি তার সাথীদের একটা গল্প শোনালো।
খেলার বন্ধুদেরকে সে বললো, “ছাদ পাড় হওয়া নিয়ে যখন আমি তোমাদের সাথে কথা বলছিলাম, তখন আমার চোখের সামনে সবুজ গাউন পরা ক’জনকে দেখলাম। তারাই আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো। তারা আমাকে উড়তে সহায়তা করেছে। তারা আমাকে আকাশ আর গ্রহ-নক্ষত্রও দেখিয়েছে। তারপর যখন আমি তোমাদের চিৎকার আর কোলাহল শুনলাম, তখন তারা আমাকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে”।
রুমির এই রহস্যময় অভিযান বা ভ্রমণের কথা বন্ধুদের মধ্যে চাওড় হবার পর খেলার সাথীদের মধ্যে তার মান-মর্যাদা বা ইজ্জত অনেক বেড়ে যায়।
রুমিকে নিয়ে এমন আরো বেশ কয়েকটা কাহিনী রুমির বাবা এবং বাবার অনুসারীদের মুখ থেকে সেই সময়ের মানুষেরা জানতে পারে।
এরকমেরই আরেকটা কাহিনী বলি। এই কাহিনীটাও ব্রাড গুচের বই থেকেই নেয়া।
তখন রুমির বয়স পাঁচ বছর। সে বয়সেই সে ‘এঞ্জেল’ বা ‘ফেরেশতা’ বা স্বর্গীয় দেবদূতদের দেখতো।
চোখের সামনে অদৃশ্য এসব স্বর্গীয় দূতদের দেখতে পেলে শিশু রুমি নাকি বিচলিত হয়ে যেতো। উত্তেজনায় লাফাতে থাকতো।
রুমির বাবা ও অন্যান্যরা তখন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করতো।
এই রকম অস্থির সময়ে রুমিকে শান্ত করার জন্য তার বাবা, বাহা ভালাদ, ছেলেকে বলতেন, এরা অদৃশ্য দুনিয়া থেকে আসা ফেরেশতা। তারা তোমার জন্য দৃশ্যমান ও অদৃশ্য অনেক উপহার নিয়ে এসেছে। তারা তোমাকে তাদের আনুকূল্য দেখানোর জন্যই তোমার সামনে দেখা দিয়েছে।
রুমির বাবা বলতেন, অস্থির ও বিচলিত হবার মতন মনে হলেও এগুলো নিয়ে ভয় পাবার কিছু নেই। বরং শিশুপুত্রের সাথে ঘটা এসকল ঘটনাকে তিনি পুত্রের প্রতি ঐশি আশীর্বাদের চিহ্ন হিসেবে দেখতেন।
কথিত আছে, তার সমবয়সী সাথীদের তুলনায় রুমি খানিকটা এগিয়ে ছিলো। শৈশবে বালক রুমি ছিলো একটু বেশিই সংবেদনশীল, অল্পতেই ঘাবড়ে যাওয়া প্রকৃতির। তবে সে ছিলো বুদ্ধিমান, উষ্ণ-স্বভাবের আর মিশুকও।
তাঁর মধ্যে উষ্ণতাপূর্ণ ভালোবাসাময় এই গুণ এসেছিলো পরিবার থেকে। পারিবারিক জীবনে যে অগাধ ইতিবাচক আচরণ ও ভালোবাসা পেয়েছিল বালক রুমি পরবর্তীতে তাই ফুটে উঠেছিল তার চরিত্রে।
এমনকি পরবর্তীতে পরিণত বয়সে রুমির লেখনিতেও পরিবারের এই উষ্ণতার ছাপ রয়েছে বলে রুমি’স সিক্রেট গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন পরিণত বয়সে সুফি কবি রুমি লিখছেন, ‘লাভ ইজ ইউর ফাদার এন্ড ইউর ফ্যামিলি’। অর্থাৎ ভালোবাসা হলো তোমার বাবা আর তোমার পরিবার।
রুমির বাবা, বাহা ভালাদ, যিনি ছিলেন সম্মানিত মাওলানা, তিনি তার বালক পুত্রের মধ্যে আগেই যেনো একটা ইশারা দেখতে পেয়েছিলেন।
তাই, বাহা ভালাদ ভেবেছিলেন, তাঁর এই পুত্রও বড় হয়ে একদিন তাঁর ও তাঁর পূর্বসূরীদের মতই ধর্মবেত্তা হবেন এবং তাঁর মতই একদিন মসজিদে জনতার মধ্যে দাঁড়িয়ে শোনাবেন প্রজ্ঞাপূর্ণ ধর্মবাণী।
রুমির জীবনী লিখতে শুরু করেছিলাম। সেই কভিডের আগে। যখনই একটু থিতু মনে বসি, তখনই একেকবার একেক ঘটনা ঘটে। সেইসব ঘটনায় প্রতিবার আমার মাথা থেকে সব নোট, গল্প হাপিস হয়ে যায়। তবু, টারমিনেটর সিনেমার ‘আস্তা লা ভিস্তা’ দৃশ্যের ভিলেনের মতন আগুনে গলে-টলে যাবার পরেও পুনরায় নিজের মনোযোগকে একীভূত করার চেষ্টা করি। কিন্তু এই চার/ পাঁচ বছরেও সেই আস্তা-লা-ভিস্তা দৃশ্যের দুষ্টচক্র থেকে বের হতে পারিনি। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, মাদার ইউনিভার্স এই আনপড়কে ইশারায় বলছেন, সোনাবাচ্চা, দম নাও! হোয়াটস দি রাশ! ফ্লাওয়ার ব্লুমস, হোয়েন দি টাইম কামস! আমার অবশ্য তাড়া না থাকলেও কমিটমেন্ট আছে একজন আন্তরিক প্রকাশকের কাছে। আগাম তিনি ৫০ হাজার টাকাও দিয়ে রেখেছেন। আরো ৫০ দেবার কথা। বিনিময়ে পাণ্ডুলিপিটা তাকে চিরতরে দিয়ে দেবার কথা। প্রকাশক আমাকে এই মর্মে রুমির জীবনী লেখার জন্যে এপ্রোচ করেছিলেন যে, রুমি নিয়ে যেহেতু আমি খুব উৎসাহী (ছিলাম), ধারাবাহিকভাবে অনুবাদ করছি (করছিলাম) তাঁর ধারণা রুমির জীবনী আমি নিবিড়ভাবে স্পর্শ করতে পারবো। আমারও তাই প্রত্যয় ছিলো (কী জানি, মনের তলে এখনো তা আছেও হয়তো। ) কিন্তু আমি আর আমার মনোযোগ– আমরা, সম্ভবত, পরস্পরের চিরশত্রু বনে গেছি। একেকবার একেক ঘটনায় মনোযোগ ছুটে গেলে সব আবার নতুন করে শুরু করতে হয়। অবশ্য প্রকাশকের দেওয়া আগাম টাকার কানা পয়সাও খরচ করিনি এই মর্মে যে, পাণ্ডুলিপি আর যদি কিছু দিনের মধ্যে দিতে না পারি, মাফ চেয়ে টাকা ফেরত দিয়ে দেবো। আর আমার রুমি থাকবেন আমার কাছে। ফুলের যদি মনে হয়, সময় ঘনিয়েছে, না ফুটে উপায় নেই, ফুল হয়তো সবেগে বৃক্ষের কঠিন কাষ্ঠ বল্কল ভেদ করে ফুটবেন। জবরদস্তি করে গাছ কাটা যায়, ফুল ফোটানো যায় না।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন, বিবিসি বাংলায় সাংবাদিকতা করেছেন। কবি ও গদ্যকার।