যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েক দফায় রাশিয়ার তরফ থেকে প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে অস্ত্র এবং অর্থ সহায়তার মাধ্যমে মদদ দেওয়া এবং ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলগুলো, যা এরই মধ্যে রাশিয়া নিজ দখলে নিয়েছে, সেগুলো পুনরুদ্ধারে কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো অবস্থা মোকাবেলা করতে হতে পারে বলে আগে থেকেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল। বর্তমান অবস্থায় এ ধরনের শঙ্কার মাত্রা অনেকটাই বেড়েছে। গত আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসা যুদ্ধে ইউক্রেন বাহিনী যখন পশ্চিমাদের দেওয়া অস্ত্র এবং অর্থের ব্যবহারেও যুদ্ধে রাশিয়ার কাছে একের পর এক ভূখণ্ড হারিয়ে আসছিল, এহেন অবস্থায় কিছুদিন ধরে তারা যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে।
গত ৬ আগস্ট থেকে রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে কুরস্কে বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলায় কিছু অঞ্চল তারা দখল করে নিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, গত কয়েক দিন আগে মস্কোসহ রাশিয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ড্রোন হামলা চালিয়েছে, যদিও এর প্রতিটি হামালাই রুখে দিয়েছে রাশিয়া। এরই মধ্যে এটি স্পষ্ট হয়েছে, এই হামলায় তারা যে বিমানগুলো ব্যবহার করেছে, সেগুলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি এবং রকেটসহ আরো কিছু অস্ত্র যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা কিছু দেশের কাছ থেকে পাওয়া। বিষয়টি রুশ কর্তৃপক্ষকে নতুন করে ক্ষুব্ধ করেছে।
রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিতে নতুন শঙ্কায় বিশ্বএর আগে রাশিয়া এই যুদ্ধটি ইউক্রেনের সঙ্গে এবং ন্যাটোকে এর সঙ্গে যুক্ত করতে আগ্রহী নয়—এ ধরনের মন্তব্য করে এলেও বর্তমান বাস্তবতায় ন্যাটোভুক্ত দেশের অস্ত্র রাশিয়ার ভূখণ্ডে আঘাত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তারা এই যুদ্ধে পশ্চিমা বিশ্ব জড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করছে, যদিও যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে দাবি করে জানিয়েছে যে রুশ ভূখণ্ডে ইউক্রেনের হামলার বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। তবে বিষয়টি রাশিয়ার কাছে যৌক্তিক মনে না হওয়ার কারণ রয়েছে, যখন দেখা যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের তরফ থেকে ইউক্রেনকে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রয়েছে; যদিও গত বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল যে ইউক্রেনকে যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য আর অর্থ দেওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে ইউক্রেনকে ১০ হাজার কোটি ডলার সহায়তার একটি প্যাকেজ আটকে দেওয়ার পর থেকে এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগতভাবে ভিন্ন পথ অবলম্বন করার পদক্ষেপ নেয়।
বড় আকারে সহায়তা দেওয়া না হলেও গত ৯ মাস সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দফায় আর্থিক সহায়তা করা হয়ে আসছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের পক্ষ থেকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কিকে ফোন দিয়ে ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের নতুন সামরিক সহায়তা প্যাকেজ প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই সামরিক সহায়তার মধ্যে রয়েছে আকাশ প্রতিরক্ষার ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন প্রতিরোধী সরঞ্জাম, সাঁজোয়া যান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং গোলাবারুদ। এ ধরনের সহায়তার আশ্বাস এমন এক সময় দেওয়া হলো, যখন ইউক্রেন রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা করেছে এবং এই হামলার জন্য রাশিয়ার পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বকে দায়ী করা হয়েছে। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো দায় নেই—যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ধরনের দাবির অযৌক্তিকতাও প্রমাণিত হয় এসব কিছুর মধ্য দিয়ে।
বাস্তবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধে সবচেয়ে আগ্রহ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় রাশিয়ার শক্তি বৃদ্ধি এবং রাশিয়া-চীন সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ যখন বিশ্বরাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে প্রচ্ছন্ন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলছিল, এমন বাস্তবতায় তাদের নেতৃত্বেও সামরিক জোট ন্যাটোকে রাশিয়ার ভূখণ্ডের আরো কাছে সম্প্রসারিত করার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার লাগাম টানার যে অভিপ্রায়, সেটাকে বাস্তবায়িত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে কোনো ধরনের কার্পণ্য থাকার কথা নয়। তবে গত বছরের অক্টোবর মাস থেকে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা এবং সেখানে তাদের সবচেয়ে বড় মিত্র ইসরায়েলের পক্ষে সর্বশক্তি নিয়োগের যে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি, সেসব বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সামরিক অর্থের একটি বড় অংশ লগ্নি করতে হয় মধ্যপ্রাচ্যে। অন্যদিকে ইউক্রেনকে সহায়তার জন্য বিকল্প ভাবনারও প্রয়োজন হয়ে পড়ে। কী সেই বিকল্প ভাবনা? এটা অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো বিষয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পশ্চিমা দেশগুলোতে গচ্ছিত রাশিয়ার সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়, যার পরিমাণ বিশাল। গত জুন মাসে জি-৭ বৈঠকে এই জোটের শীর্ষ নেতারা এই যুদ্ধের ব্যয়ভার থেকে নিজেদের কিছুটা হালকা করতে রাশিয়ার জব্দকৃত অর্থ থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার ইউক্রেনকে দিয়ে যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর এর সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমা অপরাপর দেশগুলোও ইউক্রেনকে প্রতিশ্রুত সহায়তা গত বছরের চেয়ে কমিয়ে দেয়। এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ সহায়তা প্রদান করা হয়েছে, যার পরিমাণ পাঁচ হাজার কোটি ডলারের বেশি।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা যে বিষয়টি অনুধাবন করতে পারছি, তা হচ্ছে ইউক্রেনের পক্ষে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে অস্ত্র বা অর্থ এর কোনোটিরই ঘাটতি নেই, বরং এই যুদ্ধের কৌশল ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। বর্তমানে ইউক্রেন রাশিয়ার অর্থের ব্যবহারের মাধ্যমেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরো কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তবে ইউক্রেনের এই প্রতিরোধব্যবস্থা যে খুব একটা কার্যকর হয়েছে, সেটা বলার উপায় নেই। রাশিয়া এ বিষয়ে আরো আগ্রাসী হয়েছে এবং ইউক্রেনের পুরো এলাকায় তাদের হামলার মাত্রা বৃদ্ধি করেছে। গত কয়েক দিনে কয়েক দফার এই হামলায় দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনের ব্যবহার হয়েছে। এতে ইউক্রেনের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ইউক্রেন কর্তৃপক্ষ রাশিয়ার এ ধরনের হামলার ভয়াবহতা স্বীকার করে বলেছে, পুরো ইউক্রেন রাশিয়ার ব্যালিস্টিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ভেতর রয়েছে। এরই মধ্যে রাজধানী কিয়েভে একাধিক হামলার ঘটনাও ঘটেছে। কিয়েভে এ ধরনের হামলার সতর্কতা হিসেবে আকাশ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সচল করা হলেও রাজধানীসহ দেশের মানুষকে নিরাপদ এলাকায় সরে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সংগত কারণেই রাশিয়ার পক্ষ থেকে ক্ষোভের কারণ রয়েছে। পশ্চিমারা এই যুদ্ধের শুরু থেকেই সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ থেকে বিরত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেনের পক্ষ থেকে তাদের সরবরাহ করা অস্ত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে রুশ ভূখণ্ডে হামলাকে রাশিয়া নতুন করে পশ্চিমাদের দিক থেকে একটি হুমকি হিসেবে দেখছে। সেই সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি নিজেও স্বীকার করেছেন যে রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলায় তাঁরা পশ্চিমাদের সরবরাহকৃত অস্ত্রের ব্যবহার করেছেন। রাশিয়ার ভূখণ্ডে ইউক্রেনের এ ধরনের হামলা মেনে নেওয়া রাশিয়ার মতো একটি পরাশক্তির জন্য কঠিন। অপরদিকে পশ্চিমাদের মদদে এমনটি হয়েছে, এটি জেনেও চুপ করে বসে থাকার অর্থ হচ্ছে নিজেদের দুর্বলতার প্রকাশ ঘটানো। সেই দিক বিবেচনা করেই রাশিয়ার প্রতিরক্ষা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিজেদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে প্রয়োজনে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের বিষয়টি নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকেও হুমকি দেওয়া হয়েছে এই বলে যে তাদের ভুলে গেলে চলবে না, রাশিয়ার পক্ষ থেকে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনা বা কোনোভাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সৃষ্টির মতো ঘটনা ঘটলে সেটি আর কেবল ইউরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং যুক্তরাষ্ট্রেও এর প্রভাব পড়বে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় যা অনুমান করা যায়, তা হচ্ছে এই যুদ্ধ সামনের সময়গুলোতে আরো ভয়াবহ অবস্থার দিকে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে একটি বড় ধরনের কিছু হয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। ধারণা করা যায়, ট্রাম্প যদি নির্বাচিত হয়ে আসেন, তাঁর সঙ্গে পুতিনের এক ধরনের সখ্যের কারণে তাহলে তা কার্যত রাশিয়াকে লাভবান করবে, আর যদি তিনি নির্বাচিত না হয়ে কমলা হ্যারিস নির্বাচিত হন, তাহলেও তিনি যে জো বাইডেনের অনুসৃত নীতিগুলোকে প্রতিপালন করে যাবেন, সেটি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। সেদিক বিবেচনায় আমরা যুদ্ধের বর্তমান অবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি হিসেবেই বিবেচনা করতে পারি। তবে যেভাবেই দেখি না কেন, বড় ধরনের অঘটনের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই।