ক্ষমতা গ্রহণের দুই সপ্তাহ পরে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে একটি ভাষণ দিয়েছেন। অতীতে বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পরেই সরকারপ্রধানরা ভাষণ দিয়েছেন। এবারও অনেকে অপেক্ষা করছিল কবে প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দেবেন। তবে এবারের পরিস্থিতি আগের সময়গুলোর চেয়ে একেবারে ভিন্ন।
অতীতে যতবারই নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতার পরিবর্তন হয়েছিল সেগুলো ছিল অপ্রত্যাশিত। ফলে যিনি বা যারা ক্ষমতায় এসেছিলেন তাদের ত্বরিত জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে ব্যাখ্যা করতে হয়েছিল কেন তারা ক্ষমতা দখল করেছেন এবং ক্ষমতা নিয়ে তারা কী করতে চান। এবারে এটা কোনো ক্যু দেতা নয়। এটা ছিল দুনিয়া কাঁপানো একটি গণ অভ্যুত্থান, যার লক্ষ্য আগেই নির্ধারিত ছিল। শুরুটা যেভাবেই হোক খুব অল্প সময়ে সে তার মূল লক্ষ্য পরিষ্কার করেছিল। ফলে একটি কোটাবিরোধী আন্দোলন মাত্র সপ্তাহখানেকের ব্যবধানে সরকার পরিবর্তনের আন্দোলনে পর্যবসিত হতে পেরেছিল।
পরিবর্তনের পর যে সরকার গঠিত হয়েছিল সেটাও কোনো গোপন ক্রিয়া নয়। আন্দোলনকারী যারা তাদেরই পরামর্শ মতো সরকার গঠিত হয়েছিল। অতএব নতুন সরকার কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতা গ্রহণ করল তা ব্যাখ্যা করার দরকার পড়েনি। ড. ইউনূস বলেছেন, ছাত্র-জনতাই এ আন্দোলনকে বিজয়ী করেছে। তারাই আমাকে দায়িত্ব গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছে। আমি তা গ্রহণ করেছি। সেই অর্থে শিক্ষার্থীরাই আমার প্রাথমিক নিয়োগকারী।
আন্দোলনের লক্ষ্য কি সেটাও আন্দোলনকারী কোটি জনতা আন্দোলনের মধ্যেই ব্যক্ত করেছিলেন। একটি নতুন বাংলাদেশ গড়তে হবে, পুরাতনের চাইতে যা সম্পূর্ণরূপে আলাদা। যে দেশে থাকবে না জোর করে ক্ষমতা দখল, নির্বাচনকে হাইজ্যাক করা এবং আবারও ছলে বলে, কৌশলে সেই অবৈধ ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করা। এ ক্ষমতার জোরে বিরোধী দলের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হবে, তাদের গুম করা হবে, খুন করা হবে, আয়নাঘরে রেখে নির্যাতন করা হবে। দেদার লুটপাট করে দেশকে ফোকলা বানিয়ে দেওয়া হবে, বিচার বিভাগ থেকে প্রশাসনের সব জায়গায় নগ্ন দলীয়করণ করা হবে বিরোধী মত ও পথকে দমন করার জন্য। এরকম আর হবে না। এমন একটা রাষ্ট্র গড়া হবে যা হবে গণতান্ত্রিক, মানবিক এবং কল্যাণধর্মী।
এ রাষ্ট্র কীভাবে গড়ে উঠবে? রাজনৈতিক দলগুলো দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ধরে এ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল। তাদের মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে উঠেছিল। শুরু হয়েছিল যুগপৎ আন্দোলন। সবাই একমত হয়েছিলেন, আমরা কেবল ক্ষমতায় দলবদলের লড়াই করছি না, আমরা একই সঙ্গে সরকার ও সমাজ পরিবর্তনের লড়াই করছি। দীর্ঘ আলোচনার পর রচিত হয়েছিল ৩১ দফা কর্মসূচি। এ ৩১ দফার মধ্যে রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলা হয়েছিল। (আগ্রহী পাঠক যুগপৎ আন্দোলনের এ ৩১ দফা কর্মসূচি পড়ে দেখতে পারেন)। ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিশোর শিক্ষার্থীরা যে নিরাপদ সড়কের আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তারাও রাষ্ট্র মেরামতের কথা বলেছিল।
এ রাষ্ট্র মেরামত খুব হালকা ব্যাপার নয়। সেজন্য এ পুরো রাষ্ট্রের সংস্কার করতে হবে। ড. ইউনূসও জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত তার ভাষণে এ সংস্কারের কথা বলেছেন। কৃষি থেকে শুরু করে শিল্প ও অর্থনীতির বিভিন্ন দিকের কথা বলেছেন। প্রশাসনের সর্বস্তরের কথা বলেছেন। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা বাসস্থানের কথা বলেছেন। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায়, কাজের ক্যানভাসটা কত বড়। বস্তুত সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। কোনো জায়গায় গিয়ে বলার উপায় নেই, আমার সংস্কার ক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। আর লাগবে না।
লড়াইটা শুরু হয়েছিল গণতন্ত্রের জন্য। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য। কিন্তু আমাদের দেশে গত ১৫ বছরে এই নির্বাচনি ব্যবস্থাটাই সর্বাংশে ধ্বংস হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করতে পুরো প্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্বৃত্তায়িত করে ফেলেছে। এখানে ন্যায়-নীতির কোনো বালাই নেই। যেভাবেই হোক জিততে হবে। এর জন্য যা কিছুই করা হোক তা-ই জায়েজ। এজন্য প্রশাসনকে ঘুষ দেওয়া হয়েছে। তাদের যা খুশি তাই করার মতো ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এটার সার্বিক সংস্কার ছাড়া একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন তাই অসম্ভব। এ জন্য পুরো প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে।
আমরা জানি গত নির্বাচনগুলোতে পুলিশ প্রশাসনের কী ভূমিকা ছিল, পুলিশ কত নির্মম, অমানবিক আচরণ করেছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় মানুষের এ ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখেছি। পরিস্থিতি এতদূর গড়িয়েছে যে পুলিশ কাজে যোগ দিতে ভয় পাচ্ছিল এবং এখনো পাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসন সার্বিকভাবে সক্রিয় নয়। এ পুলিশ প্রশাসন দিয়ে কি ভোট করা যাবে, এ প্রশ্ন সবার মনে। বিচারব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে যদি বলি সেখানেও তো একই অবস্থা। বিচার এবং শিক্ষা উভয় ব্যবস্থাই গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য প্রয়োজন। সংস্কারের পরিধিটা এ জন্যই বড় হয়ে যাচ্ছে।
আমি আগেই বলেছি সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া। কোথাও এটা থেমে যাওয়ার অবকাশ নেই। তার মানে কি এই যে, যতদিন সংস্কার চলবে এ সরকার ক্ষমতায় থাকবে? তা তো কোনো কথা নয়। এটাতো একটা অন্তর্বর্তী সরকার। এরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাবে। কথা হচ্ছে এ নির্দিষ্ট সময় কত বড় বা কত লম্বা।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রশ্ন করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা যেদিন জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন তার আগের দিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন, আপনারা কয়জন মিলে সংস্কার করে ফেলবেন তা তো হতে পারে না। এ জন্য অংশী সবার সঙ্গে সরকারকে কথা বলতে হবে, তাদের মতামত দিতে হবে। তিনি সরকারের কাছে একটি রোডম্যাপ দাবি করেছেন। পাঠকের হয়তো মনে আছে সরকার পতনের অব্যবহিত পরে বিএনপি তাদের অফিসের সামনে একটি জনসভা করেছিল এবং দাবি করেছিল তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে দেওয়ার। প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল এ বক্তব্যের। এত বড় একটা সংস্কারের যজ্ঞ তিন মাসেই সম্পন্ন করা যাবে? জনগণের মাঝে এরকম প্রতিক্রিয়া দেখেই কি না জানি না, বিএনপির অপর এক নেতা এটাকে ছয় মাস পর্যন্ত বাড়িয়ে দিতে রাজি আছেন বলে জানিয়েছিলেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন তার ওপরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, প্রাথমিকভাবে তারা কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছেন। তবে তিনি একই সঙ্গে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু বলেননি। আমরা আশা করেছিলাম যে, তিনি নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো রোডম্যাপ দেবেন কিন্তু ভাষণে তা নেই।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার অনুরোধে এ দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তাদেরকে কাজ করার সুযোগ দিন। তিনি এও বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে জাতির আকাক্সক্ষার প্রতিধ্বনি হয়েছে। আমরা মনে করি সরকার এখনো রাইট ডিরেকশনে আছে।
পাঠক নিশ্চয়ই এ দুই দলের বক্তব্যের পার্থক্য ধরতে পারেন জাতীয় রাজনীতির বর্তমান সময়ের কথা যদি বলি তাহলে সেটা আবর্তিত হবে এ মতপার্থক্যকে কেন্দ্র করেই। এ সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিএনপির কথাবার্তায় দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা তাগিদ আছে। কিন্তু তারা সংস্কারের বিরোধিতা করছেন না এবং বলছেন এজন্য তারা যৌক্তিক সময় দিতে রাজি আছেন। অনেকেই প্রশ্ন করছেন, এ যৌক্তিক সময় মানে কতটা সময়। কীভাবে নির্ধারণ হবে সময়ের যৌক্তিকতা? সময় ঠিক কতটা লাগবে তা নির্ভর করবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে নিশ্চিত হতে পারি। আমরা হয়তো সত্যি একটা নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাই, যে দেশ হবে ভালোবাসার। হিংসা বিদ্বেষহীন। ড. ইউনূস যেমন বলছেন, সমগ্র দেশ হবে একটি পরিবার। কিন্তু সেটা এক দিনেই গড়ে উঠবে না। তার চেয়ে বড় কথা, সেটা আবেগ দিয়ে হবে না। হতে হবে বাস্তব বিবেচনা থেকে।
ড. ইউনূস অবশ্য বলেছেন, সেটা হবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ মুহূর্তে একটি মহামূল্যবান কথা বলেছেন তিনি। কারণ শেষ বিচারে রাজনীতি হলো সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালক। আমি আশা করি আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শিক্ষক বুঝে-শুনেই এ কথা বলেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে সেই রাজনৈতিক সিদ্ধান্তটা আসবে কোত্থেকে? রাজনৈতিক দলগুলো আলাদা আলাদা করে দিলে তো হবে না। রাজনৈতিক দলগুলো একসঙ্গে বসেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারবে বলে মনে হয় না। এজন্যও এ সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। কথা বলতে হবে সব অংশীজনের সঙ্গে। সরকার যত তাড়াতাড়ি এ উদ্যোগ নেবেন ততই মঙ্গল।