খালেদা জিয়া ও হাসিনা—দুজনের শাসনই আমি দেখেছি। যদি বলা হয়, দুই আমলের প্রধান পার্থক্য কী—তাহলে আমি বলব, খালেদা যুগে মানুষ নৌকায় ভোট দিতে পারত, কিন্তু হাসিনা যুগে নৌকায় ভোট দেওয়ার সুযোগটাও হারিয়েছে। হাসিনা যুগে কোটি কোটি মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করে, বিপুল উৎসাহে যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল, তাদের আস্থা এত দ্রুত মাটিচাপা পড়বে, তা কেউ কল্পনাও করেনি।
শেখ হাসিনার সরকার আদালতের নাকে বালিশ রেখে ঘোষণা দিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে না, যা আবার আদালতেরই রায়ের বিরুদ্ধে ছিল।
কিন্তু জনগণ ইন্দ্রিয়বলে জেনে গেল, আদালতে স্থাপিত মহামান্যরা কার আলমারির পুতুল। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও একটি ইম্পার্শিয়াল জুডিশিয়ারি বাংলাদেশ পেল না, এটি খুব দুঃখের। যে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তাঁর সরকার মঞ্চে উঠেছিল, একটি ‘হুইল অব সিস্টেম’ দাঁড় করানো অসম্ভব ছিল না।
একটি টেকসই রাষ্ট্রকাঠামো, যেখানে নির্বাহী, সংসদ ও বিচার—এই তিনটি বিভাগ আপন শক্তিতে স্বাধীনভাবে চলবে। এই মহৎ স্বপ্নের বাস্তবায়ন আওয়ামী লীগের হাতের মুঠোয় ছিল।
কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার সেই পথে হাঁটেনি। গোটা জাতির মধ্যে একটি ডুয়ালিজম সৃষ্টি করা হলো।
মানুষের মধ্যে বিভেদ, হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ ও ঘৃণা ইত্যাদির চাষাবাদ করা হলো। গোটা দেশটিকে দুই ভাগ করে দেওয়া হলো—মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং বিপক্ষের শক্তি। অর্থাৎ যিনি আওয়ামী লীগ করবেন, তিনি হচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি; আর আওয়ামী লীগ না করলে তিনি হচ্ছেন স্বাধীনতাবিরোধী, স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী, যদি তিনি মুক্তিযোদ্ধা বা সেক্টর কমান্ডারও হন। সুতরাং তাঁকে মারা, পেটানো, নানা রকম অত্যাচার ও হয়রানি করা সব কিছু বৈধ—এভাবেই সরকার দেশটি চালিয়ে আসছিল।
আমরা যদি একটু ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে পৃথিবীর সব ফ্যাসিস্ট বা স্বৈরশাসক রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য বা তাঁর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এভাবে কিছু বয়ান তৈরি করতেন, যা ছিল তাঁর ক্ষমতার মূল ভিত্তি।
আসলে ফ্যাসিবাদ সমাজকে মতাদর্শিক ও সাংস্কৃতিকভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য হিটলার কিংবা মুসোলিনির মতো বিশাল ‘মহানায়ক’ বানায়, বিস্তর মিথ্যা কেচ্ছা, বয়ান ও ইতিহাস বিকৃতি ঘটায়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরাট বিরাট ছবি ও ম্যুরাল পথে-ঘাটে, এয়ারপোর্টে, অফিস-আদালতে ভরিয়ে ফেলা দেখেও ফ্যাসিবাদের কায়কারবার আপনি বুঝতে পারেন। শেখ মুজিবুরের অবদান স্বীকার করতে হবে, কিন্তু খেয়াল করুন তিনি বাংলাদেশের একমাত্র নেতা নন।
আরো একটু ভাবুন, ফ্যাসিবাদ কিভাবে কত অনায়াসে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা তর্কবিতর্ক থেকে মুছে ফেলতে পেরেছে। অথচ উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের নেতা ছিলেন ভাসানী। ভাসানী না থাকলে শেখ মুজিবুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেতেন না। কারণ শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে তিনি বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার বিপুল মানুষকে রাস্তায় নামিয়েছিলেন। যাদের বেশির ভাগই ছিল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ভাসানী ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় নেতা হতে পারতেন না।
হাসিনা সরকারের এমপি ও মন্ত্রীদের কথা শুনলে মনে হতো প্রতিভা, মেধা ও কম্পিটেন্স বলি দিয়ে ‘স্তুতিবাদ’ হয়ে উঠেছে মন্ত্রী হওয়ার প্রধান যোগ্যতা। একঝাঁক মৃত কাঠের গলায় ঝুলিয়েছে মন্ত্রিত্বের মালা। তাদের কগনিটিভ ডিক্লাইন খুব চোখে পড়ে। যার যা কাজ নয়, সে ওই কাজ নিয়ে দায়িত্ব পালনের অভিনয় করেছে।
স্মরণকালের সবচেয়ে রাষ্ট্রবিনাশী অপচয় ও দুর্নীতির অভিযোগ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে। কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস করে, টাকার মান কমেছে লুটপাটজীবীর কারণে। গরিব প্রবাসীরা যে ডলার পাঠান, সেই ডলার কর্মকর্তারা বিদেশে দুহাত ভরে খরচ করেছেন। কেউ বাড়ি কিনেছেন, কেউ প্রমোদে গেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লটবহর নিয়ে তিনি জাতিসংঘে যান। আর্বিট্রারি অ্যারেস্ট, যখন-তখন তুলে নিয়ে যাওয়া, পীড়নমূলক আইন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, টর্চার আন্ডার কাস্টোডি, আয়নাঘর, তাচ্ছিল্যপূর্ণ বক্তব্য, নকল দরদ, রঙিন দম্ভোক্তি—এসব মানুষ ভালো চোখে নেয়নি। ভয়ে হয়তো কেউ কিছু বলেনি। পুরো শাসনামলেই মানুষ কিন্তু মনের ভেতর পুষে রেখেছে রাগ ও ঘৃণা। এখন যেকোনো উপলক্ষে এই রাগ উগরে দিচ্ছে। সরকার দুর্নীতি ও মূল্যস্ফীতি রোধে কোনো কার্যকর মেকানিজম গড়তে পারেনি। সরকারপ্রধান হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন শোচনীয় ব্যর্থতার। হাজার হাজার কোটি ডলার পাচার হয়ে গেছে।
নিম্ন আয়ের মানুষ ফুড-রেশনিং করছে। দ্রব্যমূল্যের প্রচণ্ড আঘাতে তারা খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এনেছে। নিকট অতীতে বাংলাদেশে এমনটি ঘটেনি। দ্রব্যমূল্য খুব সিরিয়াস বিষয়। দেশে দেশে, রাজ্যে রাজ্যে এটি গণক্ষোভের জন্ম দিয়ে থাকে।
শেখ হাসিনাকে কারা বুদ্ধিপরামর্শ দিয়েছেন, জানি না। তবে পত্রিকা মারফত যাঁদের মুখ দেখি, তাঁদের কাউকেই জ্ঞানী ও চক্ষুষ্মান মনে হয়নি। প্রত্যেককেই অর্বাচীন ও অথর্ব মনে হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীগুলো যেন ডিপ্লোমেটিক স্যামসন। আর মুখ খুললে শেখ হাসিনাকেও অবুদ্ধিমানই দেখায়। কিছু পাখি ডানা না মেললেই বেশি সুন্দর, কিছু মানুষ মুখ বন্ধ রাখলেই অধিক উপকারী। তাঁর সংবাদ সম্মেলনগুলো হাস্যকর ও করুণ। কয়েক শ রংমিস্ত্রি সেখানে দাওয়াত পান। আঁকেন স্তবের আলপনা। গরিব ধার্মিক যে কায়দায় ঈশ্বরের প্রশংসা করেন, সে কায়দায় প্রশ্নকারীরাও তাঁর তসবিহ জপেছেন। তিনি উপভোগ করেছেন, কিন্তু আমরা দেশবাসী বিরক্ত হয়েছি। পেশাদার সাংবাদিকতার রূপ আপনি জানেন না এমনটি বিশ্বাস করা কঠিন। তার পরও বছরের পর বছর সংবাদ সম্মেলনের নামে এ ধরনের কৃত্রিম স্তোত্রের আয়োজন করা হয়েছে। অনেক সাংবাদিক দুহাত ভরে সুবিধা লুটেছেন। প্রধানমন্ত্রিত্ব ও সাংবাদিকতা—দুটিরই বিশ্বাসযোগ্যতা লম্বাকালের জন্য নষ্ট হয়ে গেছে।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। দলটি টিকবে কি না, এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সংগঠনটি স্বাধীনকাঠামো নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে এমন চিন্তা কখনো করেছে বলে মনে হয় না। এককালে আওয়ামী লীগ জনগণের দল ছিল। এখন তা পারিবারিক লিমিটেড কম্পানি ও ফ্যামিলি করপোরেশন। শেখ হাসিনা মারা গেলে দলটি গণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারবে এমন বিশ্বাস ক্ষীণ। কারণ দলের ভেতর কোনো কার্যকর গণতান্ত্রিক চর্চা চালু রাখা হয়নি। দলের সব কিছুই ছিলেন শেখ হাসিনা। কমিটি গঠনে কয়েকটি সম্মেলন করা হয়েছে। কিন্তু কেউ সভাপতি পদে দাঁড়ানোর সাহস পেলেন না। সেক্রেটারি, জয়েন্ট সেক্রেটারি—সব তিনিই ঠিক করেন। রাজনীতিবিদ সৃষ্টির কোনো অনুকূল আবহাওয়া দলটি তৈরি করেনি। যা করেছে, তা কেবলই স্থূল চিন্তার হাঙ্গামা উৎপাদন কারখানা।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বানানো হয়েছে দলীয় কার্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের এলাকা। শিক্ষিতদের চারণভূমি। এলাকাটির সব লোক একযোগে নষ্ট হবে? বেছে বেছে সবচেয়ে বাঁকা, সবচেয়ে অকেজো লোকটিকে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
ছাত্রলীগকে বানানো হলো দলীয় লাঠিয়াল। এত বড় একটি সংগঠন, কত কাজ তারা করতে পারত ছাত্রদের কল্যাণে, শিক্ষার কল্যাণে। কিন্তু ক্ষুদ্র স্বার্থে তাদের পরিণত করা হলো ভীতিকর ষণ্ডায়। এই ছাত্রদের তো এমন হওয়ার কথা ছিল না। কে তাদের জীবনখেকো সিপাহি বানাল? দল?
রাজনীতি করা নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। মানুষ নির্ভয়ে মনের কথা রাষ্ট্রকে জানাবে, সরকার সেটি মন দিয়ে শুনবে, যৌক্তিক হলে আমলে নেবে, এই তো স্বাভাবিক চর্চা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এমন অবস্থা হলো, দুটি বাক্য ফেসবুকে লিখতেও ভয় হয়। কেন এই ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হলো? মানুষ কথা বলতে পছন্দ করে। তাকে কথা বলতে দিতে হয়। চুপ হয়ে গেলে সে আরো প্রতিক্রিয়াশীল, আরো বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। আগে দোকানপাটে জমজমাট রাজনৈতিক আড্ডা হতো। ভালো হোক, মন্দ হোক—দুটি কথা মানুষ শেখ মুজিবকে নিয়ে বলত। এখন ভালোমন্দ কিছুই বলে না। কী থেকে কী হয়, এই শঙ্কায় আড়ষ্ট থাকে। মুজিববিষয়ক কোনো স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা চোখে পড়ে না। ভালোটা শুনতে হলে মন্দটা শোনার প্রস্তুতিও রাখতে হবে। কেউ কাউকে মন্দ বললেই তিনি মন্দ হয়ে যান না। বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনগণের মুখোমুখি এভাবে আর কেউ দাঁড় করায়নি।
দলের বহু কর্মী নীরব হয়ে গেছে। তাদের মনেও ক্ষোভ আছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। বিশ্বের নানা দেশে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বহু এমপি, কংগ্রেসম্যান, সিনেটর তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। ভারত ও নেপালে প্রতিবাদী মিছিল হয়েছে।
পরিশেষে মিসেল ফুকুর কথা বলেই ইতি টানতে চাই। ফুকু বলেন, পৃথিবীতে সর্বজনীন সত্য বলে কিছু নেই।
‘Truth is an effect of power’ বিভিন্ন ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো ডমিনেন্ট ডিসকোর্স তৈরি করে, পরে এটাকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেয় এবং এটাকে এস্টাবলিশ করে ওদের ক্ষমতাটাকে স্থায়ী করার চেষ্টা করে। যেমন বাংলাদেশ ১৫ বছর ধরে করার চেষ্টা করেছে। আমরা আগামী দিনে এমন এক বাংলাদেশ দেখতে চাই, যেখানে মানুষের নিরাপত্তা থাকবে, মানুষ স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবে, একটু ভালোভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারবে এবং যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার গ্যারান্টি থাকবে।