১. ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে অকাতরে প্রাণ দিয়েছে তরুণেরা। তারা প্রাণ দিয়েছে কোন দলের হয়ে নয়, বরং ফ্যাসিস্ট শক্তি বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ‘জনগণ’ হিশাবে। ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে দেশ ছাড়া করবার পেছনে প্রধান কারণ হচ্ছে দলীয়, সামাজিক, মতাদর্শিক, ধর্মীয় এবং অপরাপর বিভেদ ও বিভাজন ভুলে গিয়ে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করবার জন্য নিজেদের ‘জনগণ’ হিশাবে গঠন করতে পারা। বাংলাদেশের রাজনীতি শুধু নয়, আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এটা ছিল বিশ্ব-ঐতিহাসিক ঘটনা।
২. এই গাঠনিক প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের যে সামষ্টিক বা আত্মিক রুহানি শক্তি – যাকে পাশ্চাত্য রাজনৈতিক ও আইনী সাহিত্যে ‘জনগণের অভি প্রায়’ বা Will of the People বলা হয়, বাংলাদেশের তরুণরা দেখিয়ে দিল কিভাবে তা ‘গঠন’ করতে হয়, সেই দুর্বার শক্তির সামনে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শক্তি মার খেয়ে গেল, জয় ঘটল জনগণের অভিপ্রায়ের ।
৩. এ কালের পাশ্চাত্য দার্শনিকরা বিশেষত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো এই সামষ্টিক গণ অভিপ্রায়ের নাম দিয়েছিলেন Political Spirituality বা রাজনৈতিক রুহানি অভিপ্রায়; সংক্ষেপে ‘রুহানিয়াত’। এ নিয়ে আমি আমার ‘মার্কস, ফুকো ও রুহানিয়াত’ বইয়ে আলোচনা করেছি। এই অভিপ্রায় গ্রিক-খ্রিস্টিয় পাশ্চাত্যে সেকুলার বনাম ধর্মীয় বিভাজনের ওপর দাঁড়িয়ে যে আধুনিক রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আধুনিক রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে, মোটেও সেটা নয়। ফুকো এর নজির ইরানি বিপ্লবে দেখেছিলেন, কিন্তু পুরাপুরি ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
৪. বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমরা তারই আরেকটি ঐতিহাসিক রূপ দেখলাম। বাংলাদেশের তরুণরা পাশ্চাত্য মডেল অনুসরণ করে নি, বরং তাকে অসার ও অর্থহীন প্রমাণ করেছে। এমনকি ইরানি মডেলও অনুসরণ করে নি, কারন তা বাংলাদেশের জন্য উপযোগী নয়। তারা সম্পূর্ণ নতুন রুহানি রাজনৈতিক ধারা আবিষ্কার করেছে যেখানে সেকুলার বনাম ধর্মীয় ভেদ নাই। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ধর্ম ও মতাদর্শ নির্বিশেষে জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায়কে ঐতিহাসিক কর্তাশক্তি হিশাবে’গঠন’ করা। তাই তাদের লড়াইয়ের মাঠে তারা কোন সেকুলার বা ধর্মীয় বিভাজন বরদাশত করে নি,কোন দলীয় বা মতাদর্শিক বিভাজনও নয়। সারা বিশ্ব দেখেছে হিজাব পরেও আমাদের মেয়েরা তাদের বোন ও ভাইদের সঙ্গে দুঃসাহসের সঙ্গে লড়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছে এবং শেখ হাসিনাকে পালাতে বাধ্য করেছে। এই অভিজ্ঞতা অতুলনীয়। এই ইতিহাস একদিন আমরা লিখব, দুনিয়া বদলের রোডম্যাপ কিভাবে তৈরি করতে হয় বিশ্বের তরুণ তরুণীরা বাংলাদেশ থেকে শিখবে।
৫. বাংলাদেশের তরুণরা ক্ষয়িষ্ণু পাশ্চাত্যের ক্ষয়িষ্ণু চিন্তা ভাবনা আমাদানি করে নি, এই প্রথম আমরা দেখলাম তারা তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্মৃতি ও ধর্ম বোধের সঙ্গে তাদের মুক্ত ও স্বাধীন চিন্তা চেতনার সংযোগ ঘটিয়ে নতুন বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি আন্দোলনের শুরুরতেই, আরম্ভপর্বেই গড়ে তুলেছে। তারা পরিষ্কার দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের এই ঐতিহাসিক ও অভূতপূর্ব কালপর্বে ‘জনগণ’ শুধু তারাই যারা সকল প্রকার ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছে এবং লড়বে, যারা জীবন দিয়েছে এবং জীবন দেবে। বাংলাদেশের জনগণের জন্য তারাই দ্বিতীয় বিজয় দিবস ছিনিয়ে এনেছে।
৬. দ্বিতীয় বিজয় কেন? কারন বাহাত্তরে আমরা ‘স্বাধীনতা’ বলতে শুধু দেশ ও ভূখণ্ড বুঝেছি, জনগণের স্বাধীন রাষ্ট্র বা গণতন্ত্র কিভাবে কায়েম করতে হয় তার মর্ম ও কৌশল বুঝতে পারি নি। তাই অনায়াসে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম হয়েছে। আমরা বুঝি নি, গণতন্ত্র রাষ্ট্রের একটি ধরণ, জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় ও ক্ষমতার রূপ। সবার আগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে হবে, সরকার নির্বাচন পরে। ঘোড়ার আগে কেউ গাড়ি জুড়ে দেয় না। তাই ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে উৎখাত করা না গেলে শুধু ভূখণ্ড লাভ এবং জাতিসংঘে একটি পতাকা পাওয়াকে স্বাধীনতা বলে না।
৭. কিন্তু গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম না করে একদিকে ফ্যাসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী শক্তি একটি ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কায়েম করেছে আর আমাদের দিনের পরদিন বুঝিয়েছে এই ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম রেখে নির্বাচনই গণতন্ত্র। এই ভূয়া নির্বাচন সর্বস্ব তত্ত্ব দিয়ে শুধু ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রই কায়েম করা হয় নি, একই সঙ্গে লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীকেও বাংলাদেশে অবাধে লুটপাট করতে দেওয়া হয়েছে। টাকাওয়ালা লুটেরা ছাড়া কারো পক্ষেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা সম্ভব না। যারা কোটি টাকা রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিতে পারে তারাই জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হয়, কিন্তু তাদের আবার কোন ক্ষমতা নাই। সকল ক্ষমতা প্রধান মন্ত্রীর — অর্থাৎ দলনেত্রীর। কালোটাকার মালিক মাফিয়া ছাড়া জনগণের পক্ষে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবার সুযোগ খুবই ক্ষীণ। এই মাফিয়া ও লুটেরা শ্রেণীকে ক্ষমতায় বসানোকেই তারা এতদিন গণতন্ত্র বলে আমাদের চোখে ধোঁকা দিয়ে এসেছে। আর না। এই লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণীর নির্বাচনবাদকে রুখে দিতে হবে। জনগণের সামষ্টিক অভিপ্রায় ধারণ করতে সক্ষম নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ‘গঠন’ ও কঠোর নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলাই প্রথম কাজ। এই মৌলিক কাজে ব্যর্থ হলে শহিদ ও বাকি জীবন পঙ্গু হয়ে পড়া হাজার হাজার মানুষের কাছে আমরা দায়ী হয়ে থাকব।
৮. যে গাঠনিক প্রক্রিয়া আন্দোলনের আরম্ভপর্বে শুরু হয়েছে সেই গণঐক্য অক্ষুণ্ণ রাখা আমাদের এখনকার প্রথম ও প্রধান সংকল্প। দরকার ‘জনগণ’ কথাটির মর্ম উপলব্ধি করা, এবং বুঝতে শেখা এই সময় কোন রাজনৈতিক দল নয়, জনগণই কর্তাশক্তি। রাজনৈতিক দলের ভূমিকা হচ্ছে জনগণের এই কর্তাশক্তিকে (Constituent Power) আরও বলবান এবং আরও শক্তিশালী করা। দল হিশাবে আমাদের ভুমিকা শুরু হবে যখন বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠনের প্রক্রিয়াকে আমরা পূর্ণতার দিকে নিতে পারব এবং একটি গঠনতান্ত্রিক সভা (Constituent Assembly) আহ্বানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্য নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ জনগণের সম্মতি ক্রমে আমরা গ্রহণ ও প্রতিষ্ঠিত করতে পারব। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নির্মাণ করতে পারব। এই গাঠনিক পর্বে জনগণের মধ্যে বিভেদকারী সকল শত্রু ও ষড়যন্ত্রবাজদের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হয়ে যেতে হবে।
৯. এদের আমরা কিভাবে চিনব? এরা শহিদের রক্ত রাজপথে শুকাবার আগেই তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন দাবি করছে। এরা দাবি করছে গণঅভিপ্রায়ের দ্বারা নির্বাচিত ড. ইউনুস ‘নির্বাচিত’ নন। অথচ গণ অভ্যূত্থানের দ্বারা অর্থাৎ জনগণের সর্বোচ্চ অভিপ্রায়ের প্রতিনিধি হিশাবেই তিনি নির্বাচিত। তারা দাবি করছে কালো টাকার লেনদেনের মধ্য দিয়ে চোরডাকাতদের ভোট দিয়ে সংসদে বসালেই নাকি তারা ‘নির্বাচিত’ হয়; এবং শেখ হাসিনার সংবিধান অনুযায়ী একজন নতুন সাংবিধানিক ফ্যাসিস্ট শাসক ‘নির্বাচন’ করাই নাকি গণতন্ত্র।
জনগণের বিজয়কে নস্যাৎ করবার চেষ্টা চলছে বিভিন্ন দিক থেকে। হুঁশিয়ার!