সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেশের পুঁজিবাজার, বিশেষ করে সেকেন্ডারি মার্কেট অর্থাৎ স্টক মার্কেট ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই ঢাকা ও চট্টগ্রাম উভয় স্টক মার্কেটে শেয়ার মূল্যসূচকের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে, যা পরবর্তী দু-এক দিন অব্যাহত থাকার পর কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, যাকে মূলত বাজার সংশোধন বলা হয়ে থাকে। এটি নিশ্চয়ই আশার কথা। নানা কারণে দেশের পুঁজিবাজার দীর্ঘদিন খারাপ অবস্থায় ছিল।
বলা চলে দেশের শেয়ার মার্কেট একেবারে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। বিনিয়োগকারীরা দেশের এই বিনিয়োগ কেন্দ্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এখন যেহেতু দেশে একটা পরিবর্তন হয়েছে এবং পরিবর্তনের কারণে দেশের বিনিয়োগকারীদের মাঝে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। ফলে তারা পুজিবাজারে ফিরতে শুরু করেছে এবং বিনিয়োগও করছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে স্টক মার্কেটে শেয়ার মূল্যসূচকের রেকর্ড বৃদ্ধির মাধ্যমে।
এটা খুবই স্বাভাবিক এবং এটাই হয়ে থাকে। পুঁজিবাজারে বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজনএ কথা সর্বজনবিদিত যে দেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে হলে কার্যকর এবং বিনিয়োগবান্ধব পুঁজিবাজারের কোনো বিকল্প নেই। সত্যি বলতে কি পুঁজিবাজারের গতি-প্রকৃতিই দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির নির্দেশক (ইনডিকেটর) হিসেবে কাজ করে। উন্নত বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নতি বা মন্দা নিরূপণ করা হয় যে কয়েকটি ইনডিকেটর দিয়ে তার মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে শেয়ারবাজারের মূল্যসূচক এবং আরেকটি হচ্ছে আবাসন বা রিয়েল এস্টেটের বাজারদর।
আমেরিকা, কানাডা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যখন শেয়ারবাজারে মূল্যসূচক ঊর্ধ্বগতি হয় এবং বাড়ির মূল্যবৃদ্ধি পায়, তখন অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। এর বিপরীত অবস্থা যখন বিরাজ করে তখন মনে করা হয় যে দেশের অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করছে। আমাদের দেশে রিয়েল এস্টেট বা বাসাবাড়ি ক্রয়-বিক্রয় এখনো সেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। এখনো রিয়েল এস্টেট বিনিয়োগের মাধ্যম হয়ে গড়ে উঠতে পারেনি এবং নিজেদের আবাসস্থল হিসেবেই রয়ে গেছে। ফলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির ইনডিকেটর হিসেবে রিয়েল এস্টেটের সে রকম কোনো ভূমিকা নেই।
অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে পুঁজিবাজার। বিগত দুই দশকে আমাদের দেশের পুঁজিবাজারের ব্যাপ্তি ও কলেবর বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু কার্যকর বা ম্যাচিউরড পুঁজিবাজার বলতে যা বোঝায় সেখান থেকে আমাদের দেশের পুঁজিবাজার এখনো অনেক দূরে। উপরন্তু আমাদের দেশের পুঁজিবাজার নানা অনিয়মের অভিযোগে অভিযুক্ত। বিগত কয়েক বছর ধরে দেশের স্টক মার্কেট মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। নির্বিচারে ফ্লোর প্রাইস প্রয়োগ করে স্টক মার্কেটকে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করা হয়েছে। অনেক সমালোচনার পর যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ না করে ফ্লোর প্রাইস উঠিয়ে নেওয়ার কারণে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ফলে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরেনি এবং এই বাজার চাঙ্গাও হয়নি।
সরকার পরিবর্তনের ফলে, বিশেষ করে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে এবং তাদের মাঝে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে। পুঁজিবাজার এমনিতেই খুব সংবেদনশীল একটি বিনিয়োগ ব্যবস্থা। এই সংবেদনশীলতা দুটো কারণে হতে পারে, যার একটি হচ্ছে আর্থিক সংবেদনশীলতা এবং আরেকটি হচ্ছে অর্থনীতি-বহির্ভূত সংবেদনশীলতা। দেশের অভ্যন্তরে বা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কোনো রকম আর্থিক পরিবর্তনের ঘটনা ঘটলে তার প্রভাব পুঁজিবাজারে পড়বেই। যেমন— জাপানের ফিসক্যাল পলিসি বা মুদ্রানীতিতে পরিবর্তন আনার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্টক মার্কেটে শেয়ার মূল্যসূচকের উঠানামা পরিলক্ষিত হয়। এমনও দেখা যায় যে সৌদি আরবে জালানি তেল উৎপাদন হ্রাস-বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে অন্যান্য খাতের শেয়ার মূল্যসূচকের ওপর। একইভাবে অর্থনীতি-বহির্ভূত কোনো বিষয়, এমনকি রাজনৈতিক কোনো পরিবর্তনের ঘটনা ঘটলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের স্টক মার্কেটে তার প্রভাব পড়ে। ব্রিটেনের লেবার পার্টি ক্ষমতায় আসার সংবাদেও আমেরিকা ইউরোপের স্টক মার্কেটে শেয়ার মূল্যসূচকের পরিবর্তন হয়। ইন্দোনেশিয়ার ভূমিকম্প বা হংকংয়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে বিশ্বের বেশির ভাগ স্টক মার্কেটে। একই পথ অনুসরণ করে আমাদের দেশের সরকার পরিবর্তনের ফলে শেয়ার মার্কেটে চাঙ্গাভাব দেখা দিতেই পারে।
নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের কারণে বিনিয়োগকারীরা শেয়ার মার্কেটে বেশি বেশি বিনিয়োগ করবে এবং মার্কেটে চাঙ্গাভাব বিরাজ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে এই বিনিয়োগের সুযোগ কাজে লাগিয়ে যাতে সুযোগসন্ধানীরা বা বাজার কারসাজিতে লিপ্ত দুষ্ট বিনিয়োগকারীরা সুবিধা নিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সর্বস্বান্ত করতে না পারে এবং দেশের পুঁজিবাজারে জালিয়াতির সুযোগ না পায়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আমাদের দেশের শেয়ারবাজার যে অবস্থানে বিরাজ করছে তাতে এ রকম বাজার কারসাজির সমূহ সম্ভাবনা আছে। ফ্লোর প্রাইস বলবৎ থাকায় বেশির ভাগ শেয়ারের মূল্য সর্বনিম্ন পর্যায় বিরাজ করছে। এর ফলে এখন স্টক মার্কেটে শেয়ারের যে মূল্য আছে তা প্রকৃত মূল্য কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে এখন শেয়ার ক্রয়ের একেবারে উপযুক্ত সময়। কিন্তু সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কখনোই প্রবর্তনের শুরুতে শেয়ার ক্রয় করতে চায় না, উল্টো অপেক্ষা করে বাজার পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। শেয়ারের মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে পেতে যখন মোটামুটি সর্বোচ্চ পর্যায় পৌঁছে যায় এবং বাজারে যখন মাত্রাতিরিক্ত চাঙ্গাভাব বিরাজ করে তখন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ক্রয় করতে শুরু করে। অর্থাৎ যখন শেয়ার ক্রয়ের উপযুক্ত সময় তখন ক্রয় না করে, যখন শেয়ার বিক্রির উপযুক্ত সময় তখন তারা ক্রয় করে থাকে।
শেয়ারবাজারে যারা চতুর বা সুযোগসন্ধানী বিনিয়োগকারী হিসেবে পরিচিত তারা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের এ রকম ধারণা বা মনস্তাত্ত্বিক অবস্থান বেশ ভালোভাবেই জানে। ফলে সুযোগসন্ধানী বিনিয়োগকারীরা এখন পর্যাপ্ত শেয়ার ক্রয়ের পাশাপাশি বাজারে কৃত্রিমভাবে শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি করে বাজারকে ঊর্ধ্বমুখী দেখানোর মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে। তাদের বাজার কারসাজির ফাঁদে পা দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা যখন শেয়ার ক্রয় করতে শুরু করবে তখন সুকৌশলে সুযোগসন্ধানী বিনিয়োগকারীরা বা বাজার কারসাজিতে লিপ্ত বিনিয়োগকারীরা উচ্চমূল্যে শেয়ারগুলো সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছে বিক্রি করে দিয়ে বাজার থেকে অধিক মুনাফা তুলে নিয়ে কেটে পড়তে পারে। এমনটা হলে সর্বস্বান্ত হবে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এবং অভিযোগ উঠবে বাজার কারসাজির। যেকোনো বড় ধরনের পরিবর্তনের পর শেয়ারবাজারে কারসাজি খুবই সাধারণ ঘটনা। এ রকম অনভিপ্রেত ঘটনা আমাদের দেশের শেয়ার মার্কেটে এর আগে যে ঘটেনি, তেমন নয়। বরং একাধিকবার এ রকম ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।
একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে এবং শেয়ারবাজারে আর যেন কোনো রকম কারসাজির ঘটনা না ঘটে সে জন্য এই বাজারে শুরু থেকেই কঠোর নজরদারি বজায় রাখা প্রয়োজন। শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় যেন স্বাভাবিক গতিতে হয়, তা শতভাগ নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে। সুযোগসন্ধানী বিনিয়োগকারীরা যেন কৃত্রিমভাবে মূল্য বৃদ্ধি করতে না পারে এবং শেয়ারের কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি করে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের ফাঁদে না ফেলতে পারে, সেদিকে নিয়ন্ত্রক সংস্থার তীক্ষ দৃষ্টি রাখতে হবে। এমনকি মূল্য সংবেদনশীল তথ্যকে কাজে লাগিয়ে যেন সুযোগসন্ধানীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের প্রতারণা করতে না পারে সেটিও নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে। বিনিয়োগবান্ধব, কার্যকর ও স্থিতিশীল পুঁজিবাজার নিশ্চিত করার স্বার্থে যে যে বাড়তি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তার সবই নিতে হবে। সরকার পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে দেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে যে আস্থার সৃষ্টি হয়েছে সেই আস্থা যেন অটুট থাকে এবং দেশের পুঁজিবাজার যেন একটি দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগ কেন্দ্রে পরিণত হয়, সে জন্য দেশের পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রথম থেকেই গুরুত্ব দিয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। এরই মধ্যে বিএসইসির (বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন) চেয়ারম্যান এবং একজন সদস্য পদত্যাগ করেছেন। নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিএসইসির দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা যাতে নতুন কমিশনকে সঠিক পরামর্শ দিয়ে ও সর্বাত্মক সহযোগিতা করে দেশের পুঁজিবাজারকে কার্যকর, টেকসই এবং বিনিয়োগবান্ধব কেন্দ্রে রূপান্তর করতে পারে সেই প্রত্যাশা সবার।