ঋণের ৯ শতাংশ সুদ বেড়ে ১৫ শতাংশ হয়েছে। সামনে আরও বাড়তে পারে। কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা যাচ্ছে না। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম তিন গুণ বেড়েছে।
শিল্পে নতুন গ্যাস সংযোগও বন্ধ। মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতায় ঊর্ধ্বমুখী জ্বালানি তেলের দাম। এসব কারণে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে দেশের শিল্প খাতে। ফলে সময়মতো ঋণ পরিশোধ করতে না পারায় খেলাপির তকমা লাগছে ভালো ব্যবসায়ীদের গায়ে।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এতে সময়মতো ঋণের কিস্তি পরিশোধে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। খেলাপির ঝুঁকিতে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা।
মঙ্গলবার (২০ আগস্ট) ঝুঁকি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে বৈঠকে বসবে। এদিকে সংকট কাটিয়ে ওঠার জন্য শিল্পোদ্যোক্তাদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এ বিষয়ে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, ব্যবসায়ীরা যাতে খেলাপি না হন, ঋণ পরিশোধে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়, ঋণসংক্রান্ত সমস্যাগুলো সমাধানে করণীয় নির্ধারণে আমরা আজ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করব।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেছেন, সব ক্ষেত্রে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত বিদ্যুৎ কেনার বিশেষ আইন এবং সংশ্লিষ্ট দায়মুক্তি আইন বাতিল করে বিদ্যুৎ খাতে প্রতিযোগিতা ও জবাবদিহির দুয়ার খুলে দিতে হবে।
জানা গেছে, ২০২০ সালে মহামারি কোভিড-১৯ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে ও বিদেশে দীর্ঘদিন লকডাউন দেওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। ব্যবসায়ীরা এ প্রভাব থেকে এখনো মুক্ত হতে পারেননি। তা ছাড়া প্রচুর আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়ে ব্যাংক ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করলেও ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। মহামারি করোনার প্রকোপ শেষ হতে না হতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। এসব যুদ্ধের কারণে বহির্বিশ্বে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে বহুগুণ। সেই সঙ্গে জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামায় দেশের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় দেখা দেয় মারাত্মক বিপর্যয়।
উৎপাদন ও সরবরাহ বন্ধ থাকায় ঋণ পরিশোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এসবের সঙ্গে শুরু হয় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমার প্রতিযোগিতা।
গত ১ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ৩১ জুলাই পর্যন্ত রিজার্ভ দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার, যা বিগত জুনে ছিল ২১ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার। ৩১ জুলাই পর্যন্ত যে রিজার্ভ, তা বাংলাদেশের তিন মাস সাত দিনের আমদানি ব্যয় মেটাতে পারবে। রিজার্ভ কমার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বৈদেশিক মুদ্রা মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, অর্থাৎ টাকার অবমূল্যায়ন। যেখানে দীর্ঘদিন যাবৎ মার্কিন ডলারের মূল্য ছিল ৮৬ ও ইউরো ৯৭ টাকা। বর্তমানে সেই ডলারের দাম বেড়ে ১১৮ ও ইউরো ১৩৫ টাকা হয়েছে। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে কাঁচামাল এবং জ্বালানি তেলের দাম এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছে।
এদিকে, উৎপাদন খরচ যে হারে বেড়েছে ফিনিশড প্রোডাক্টসের দাম সে হারে বাড়েনি। এর ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এতেও ঋণ পরিশোধে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সুদহারের সীমা তুলে দেওয়ার পর ঋণের সুদ বেড়ে ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে দেশের অর্থনীতি। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ধারাবাহিকভাবে কমছে।
মূল্যস্ফীতি ও রিজার্ভ বাড়াতে আবারও নীতি সুদহার বা পলিসি রেট বাড়াতে পারে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এ প্রস্তাব দিয়েছেন। ঋনের সুদ আবার বাড়লে আরও লোকসানে পড়বেন শিল্পমালিকরা।
বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক দফায়। চলতি বছরের এপ্রিলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ১৪ দশমিক ৭৫ টাকা থেকে ৭৫ পয়সা বাড়িয়ে ১৫ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে কলকারখানায় ব্যবহৃত ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটারে ৭৫ পয়সা বাড়িয়ে ৩১ টাকা ৫০ পয়সা করেছে। একইভাবে এ বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। মূল্যবৃদ্ধির ফলে ইউনিটপ্রতি খুচরা বিদ্যুতের দাম গড়ে ৮ টাকা ২৫ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ টাকা ৯৫ পয়সায় দাঁড়িয়েছে। আর পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। এতে পাইকারি বিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ টাকা ৪ পয়সায়।
সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাস্তবায়নকালীন প্রকল্পগুলোয় বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ইত্যাদির সংযোগ না দেওয়ায় দীর্ঘদিন যাবৎ অনেক প্রকল্প উৎপাদন শুরু করতে পারেনি। ফলে এসব কারখানার ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা নষ্ট হবে। প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে কলকারখানার কাক্সিক্ষত কাঁচামাল, স্পেয়ার পার্টস ও নতুন প্রকল্পের মেশিনারিজ আমদানিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। ফলে কাঁচামালের অভাবে অনেক ইন্ডাস্ট্রি প্রায়ই বন্ধ রাখতে হচ্ছে।
দেশের ব্যাংকগুলোয় বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে ছয় মাসের ইউপাসে ঋণপত্র খুলে কাঁচামাল আমদানি করে উৎপাদন অব্যাহত রাখলেও বৈদেশিক মুদ্রার বৃদ্ধির কারণে যে দামে ফিনিশড প্রোডাক্টস বিক্রি করা হয়েছে ছয় মাস পর তার চেয়ে বেশি দামে বৈদেশিক মুদ্রা কিনে ইউপাস এলসির দায় পরিশোধ করতে হয়েছে। ডলারের বিনিময় হার ২৫ শতাংশের বেশি বেড়ে যাওয়ায় লাভের বিপরীতে বিপুল লোকসান গুনতে হচ্ছে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিকারকদের।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা বলা হলেও প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও অনেক বেশি।