ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না, থাকলে তার ধরন কী হবে, তা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে। ছাত্ররাজনীতির সংজ্ঞা নিয়েও রয়েছে নানা মত। সাধারণভাবে ছাত্ররাজনীতি হলো ছাত্রদের জন্য শিক্ষা, সংস্কৃতি, ক্রীড়া, আপ্যায়ন ও সমাজসেবা ইত্যাদি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বা শিক্ষাবহির্ভূত কার্যক্রম পরিচালনা করতে সহায়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় প্রাধান্য বিস্তারমূলক কর্মকাণ্ড। ছাত্রদের মধ্যে কেউ কেউ আছে, যাদের মধ্যে নেতৃত্বদানের সহজাত গুণাবলি থাকে।
কারণ তাদের মধ্যে থাকে শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করার মতো সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব। স্বাভাবিকভাবে ছাত্ররাজনীতিতে এসব সহজাত উত্তম গুণসম্পন্ন ছাত্রনেতাদেরই শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব দান করার কথা। কিন্তু বাস্তবে এরূপটি ঘটে না। এর প্রধান কারণ রাজনীতি এমন একটি কর্মকাণ্ড, যেখানে নানা রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহির্ভূত উপাদান কার্যকর থাকে।
কারণ বাস্তবে ছাত্রনেতারা ছাত্রদের দলগত যেকোনো কার্যক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নিজের অবস্থানকে দৃঢ় করতে নানা কূটকৌশল ও বল প্রয়োগ করে থাকে। কূটকৌশলের মধ্যে রয়েছে কূটতর্ক, প্রতিপক্ষের চরিত্র হনন ও অনুসারীদের বিশেষ সুবিধা প্রদান। বল প্রয়োগের মধ্যে রয়েছে ভীতি প্রদর্শন ও মারপিট। রাজনীতিবিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী রাজনীতিবিদরা নিজের প্রাধান্য দৃঢ় করতে সর্বদাই এই কূটকৌশল ও বল প্রয়োগের মতো হাতিয়ার ব্যবহার করে থাকেন।
কুশলী ছাত্রনেতারা সে সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহির্ভূত শক্তির কাছ থেকে এই সহায়তা গ্রহণ করে থাকে। বাংলাদেশে ছাত্রনেতারা সাধারণত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহির্ভূত এই প্রয়োজনীয় শক্তি প্রভাবশালী রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে লাভ করে থাকে। এভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছাত্ররাজনীতি এখন দলীয় রাজনীতির অঙ্গীভূত হয়ে পড়েছে।
চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাহী আদেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ছাত্ররাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এখন কথা হলো ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা সম্ভব কি না? উত্তর হলো সম্ভব নয়। কারণ রাজনীতিশূন্য কোনো সমাজ হয় না। যেখানে সমাজ আছে, সেখানেই রাজনীতি আছে। ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিও কার্যত একপ্রকার ছাত্ররাজনীতি। নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের কথা বলা হলেও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকেই ছাত্রনেতারা দলগত কর্মকাণ্ডে তাদের প্রাধান্য দৃঢ় করতে নানা কূটকৌশল ও বল প্রয়োগ করেই যাবে। এরই মধ্যে একমাত্র ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলভুক্ত ছাত্রসংগঠনের নেতা-নেত্রীরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতে প্রবেশ করেছে এবং তারা তাদের সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করছে। বাংলাদেশের এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ছাত্ররাজনীতি বন্ধ না করে কিভাবে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতি চালু করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা দরকার। দুটি পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলভুক্ত ছাত্রসংগঠনের প্রভাব কমিয়ে এনে ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতি চালু করা সম্ভব বলে ধারণা করা যেতে পারে।
প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতে বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ সীমিত করতে অপেক্ষাকৃত নবীন শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হলের কক্ষ বরাদ্দ দেওয়ার নিয়ম চালু করা প্রয়োজন। বর্তমানে আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রাবাসগুলোতে কক্ষ বরাদ্দের অযৌক্তিক নিয়ম প্রচলিত আছে, যেখানে একজন নবীন শিক্ষার্থীকে ছাত্রাবাসে কক্ষ পেতে লাগে কয়েক বছর। অথচ যারা বয়সে প্রবীণ, বিশেষ করে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তারা কক্ষ ধরে রাখতে পারে কয়েক বছর। সে জন্য বর্তমান ব্যবস্থায় একজন নবীন অপরিণত বয়সের শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি বুঝতে না বুঝতেই কতগুলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত ঝুঁকি মোকাবেলা করতে হয়। আর অন্যদিকে এই ব্যবস্থায় ছাত্রাবাসে প্রবীণদের থাকে সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সুযোগ এবং নবীনদের ওপর কর্তৃত্ব করার সুযোগ। কাজেই একজন নবীন শিক্ষার্থী, যে সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে আসে, তাকে আবাসিক কক্ষ বরাদ্দ পেতে একবার ছাত্রাবাস প্রশাসনে দৌড়াতে হয়, আরেকবার প্রবীণ ছাত্রনেতাদের কাছে ধরনা দিতে হয়। ছাত্রাবাসে কক্ষ পেতে এই যে গণ্ডগোল, তা-ই ছাত্ররাজনীতির নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। কাজেই ছাত্রাবাসে কক্ষ বরাদ্দের এই নিয়মটি ভেঙে ছাত্রাবাসগুলোতে বাসকক্ষ বরাদ্দের যৌক্তিক নিয়ম চালু করা প্রয়োজন, যেন নবীন শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আবাসকক্ষ বরাদ্দ পায়।
প্রস্তাবিত এই পদ্ধতিতে ছাত্রাবাসগুলোতে আবাসকক্ষের সংখ্যানুসারে যথাক্রমে প্রথম বর্ষ ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বরাদ্দ পাবে। অর্থাৎ প্রস্তাবিত কক্ষ বরাদ্দের নিয়মটি মেধাভিত্তিক হবে না, বরং শিক্ষাবর্ষভিত্তিক হবে। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের কক্ষ বরাদ্দ দানের পর তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু কক্ষ শূন্য থাকলে সেগুলোতে মেধার ভিত্তিতে কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া যেতে পারে। আবাসকক্ষের সংখ্যা স্বল্পতার কারণে তৃতীয় শিক্ষাবর্ষ বা তদূর্ধ্ব শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা অপেক্ষাকৃত নবীন শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কক্ষ পরিত্যাগ করবে। কারণ তখন তারা ছাত্রাবাস থেকে বেরিয়ে নিজের পছন্দমতো আবাসিক ব্যবস্থা করার মতো যথেষ্ট অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হবে। কাজেই এই প্রস্তাবিত প্রক্রিয়ায় প্রবীণদের ছাত্রাবাসে বাসকক্ষ ধরে রেখে ছাত্ররাজনীতির কূটচক্র তৈরি করতে পারবে না। সে জন্য ছাত্রাবাসগুলোতে কোনো প্রকার দ্বন্দ্ব, মারামারি ও ঝগড়া-বিবাদের সুযোগ থাকবে না। তা ছাড়া ছাত্রনেতাদের জাতীয় নেতৃত্বের প্রভাব খাটিয়ে শিক্ষকদের ওপর খবরদারি করার বর্তমান প্রক্রিয়াটির কার্যকারিতা হারিয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালুর পরিবেশ সৃষ্টি করতে ধারাবাহিকভাবে প্রতিবছর ছাত্রসংসদ নির্বাচন চালু রাখা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি—এসব রাজনৈতিক দল অতীতে ক্ষমতাসীন হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান বন্ধ রাখে। উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ছাত্রদের দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাববলয় বিস্তৃত করা। কারণ রাজনৈতিক নেতারা জানেন যে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নির্বাচনের সুযোগ থাকলে আঞ্চলিক পর্যায়ে যে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হয়, তাদের ওপর অনৈতিক প্রভাব খাটানোর সুযোগ থাকে না। চাঁদাবাজি, দুর্নীতি ও দখলদারির মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জনও বন্ধ হয়ে যায়। এসব কারণে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রতি সাধারণ ছাত্ররা কিছুটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করে। ছাত্রসংসদ নির্বাচনের অতীত ইতিহাস থেকে দেখা যায়, সাধারণত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের চেয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলভুক্ত ছাত্রসংগঠন বা নিরপেক্ষ ছাত্রসংগঠনই ছাত্রসংসদে জয়ী থাকে। কাজেই ছাত্রসংসদের ইতিহাস থেকে পাঠ নিয়ে আমরা বলতে পারি, প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এবং ছাত্রাবাসগুলোতে ছাত্রসংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতির পরিবেশ সৃষ্টি করবে। অধিকন্তু দেশে একটি বিকল্প রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবে। এই নেতৃত্ব পরিবারতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিকল্প হিসেবে জাতীয় রাজনীতিতে ইতিবাচক উপাদান যোগ করবে। ফলে দেশে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টি হবে।
কাজেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ না করে প্রস্তাবিত উপায়ে পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত ইতিবাচক ছাত্ররাজনীতি চালু করা প্রয়োজন।