বাংলাদেশের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, এই মুল্লুকে যে কয়টি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে প্রায় সবকটিতেই ছাত্র সমাজের বিস্তার এবং প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। বেশিরভাগ অভ্যুত্থানের শুরুতে ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ দাবিকে শাসকদের তোয়াক্কা না করা ডেকে নিয়েছে তাদের পতন, আর জন্ম নিয়েছে ইতিহাসের আরেকটি নতুন অধ্যায়ের।
চলতি বছর হয়ে যাওয়া এ গণঅভ্যুত্থানের মেয়াদ কমবেশি এক মাসের। জুন মাসে একেবারেই নিরেট ছাত্র আন্দোলন জুলাইয়ের শেষে এসে রূপ নিয়েছে গণঅভ্যুত্থানে। আর সেই অভ্যুত্থানের ফল হয়েছে বিগত চারটি অভ্যুত্থানের মতোই ঐতিহাসিক।
এশিয়াটিক সোসাইটির ইতিহাস থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রতিটি অভ্যুত্থান আগুনের ফুলকি দিয়ে শুরু হলেও সরকারের প্রধান ভুল ছিল অভ্যুত্থান দমাতে বুলেটের ব্যবহার। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে সালাম-রফিক, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে আসাদ-মতিউর, ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ, নব্বইয়ের এরশাদ পতন আন্দোলনে নূর হোসেন আর এবারের গণঅভ্যুত্থানে আবু সাইদ-মীর মুগ্ধের মতো শতাধিক ছাত্রের মৃত্যুর পেছনে ব্যবহৃত বুলেট বুমেরাং হয়ে ফিরে গিয়েছিল শাসক যন্ত্রের কাছেই। শেষ পর্যন্ত ঘটে গেল সরকারের পতন।
রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে অভ্যুত্থান এসে থেমেছে রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে। মাঝে পেরিয়ে গেছে ৭০ বছরের বেশি সময়, বদলে গেছে বিপ্লবের বাণী, মিছিলের স্লোগান, আন্দোলনের দাবি আর অভ্যুত্থানের ভাষা।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ভাষা নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহাত আহমদে জানান, ‘আমরা শুরু করেছিলাম কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে। তখনই ঘুণাক্ষরে ভাবিনি এই কোটা সংস্কার রূপ নেবে রাষ্ট্র সংস্কারের মতো বিশাল ব্যাপারে। যেখানে অভ্যুত্থানের ভাষা ছিল কোটা না মেধা, সেই ভাষাই ক্রমান্বয়ে এবং সময়ের প্রয়োজনে বদলে ফিয়ে ফ্যাসিজমের বিপক্ষে শক্ত ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
অল্পদিনের ব্যবধানে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ধাপে ধাপে রূপ নিয়েছে গণবিপ্লবে। যুক্তরাজ্যের সেন্ট এন্ড্রুস বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বিদ্রোহ মূলত ক্ষমতার পালাবদল ঘটায়, আর বিপ্লব পরিবর্তন আনে পুরো কাঠামোতে। এবারের গণবিপ্লবের মূল কথা হচ্ছে রাষ্ট্রকে ঢেলে সাজানো এবং কোনোভাবেই যাতে ফ্যাসিজম আর ফেরত না আসে সেই বন্দোবস্ত করা।
বিপ্লবের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রকে ঢেলে সাজানো দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার হলেও ফ্যাসিজম যাতে আর ফেরত না আসে সে ব্যাপারে নিশ্চয়তার জন্য সবার আগে প্রয়োজন কীভাবে একটি সরকার ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠে কিংবা কীভাবে গণতন্ত্রের মখমলে মোড়ানো রাষ্ট্রযন্ত্র ফ্যাসিস্টদের মতো আচরণ করে।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব এসেক্সের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পিএইচডি গবেষক আনোয়ার আজিম সময় সংবাদকে বলেন, বর্তমানে সময়ে ফ্যাসিস্ট কখনো মুসোলিনীর মতো ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতার সিংহাসনে আরোহন করে না। বেশিরভাগ দেশে গণতন্ত্রের মখমলে মোড়ানো চাদরের মধ্যে ফ্যাসিস্ট সরকার লুকিয়ে থাকে এবং কালের ক্রমান্বয়ে তার স্বরূপ মানুষের মাঝে উন্মোচিত হয়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আনোয়ার বলেন, হাসিনা সরকার ২০০৯ সালে পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। সেসময়ে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল তরুণ প্রজন্মের ভোট। যে তরুণ প্রজন্ম আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার গদিতে বসিয়েছে তারাই আবার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে নামিয়ে দিয়েছে। মাঝে কেটে গেছে প্রায় দুই দশক।
টানা তিন মেয়াদ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে তাদের মনে হয়েছিল এ সরকারের পতন ঘটানো এক রকমের অসম্ভব। এটা ফ্যাসিস্ট সরকারের সাধারণ ভুল- তারা ভাবে ক্ষমতার চেয়ার চিরস্থায়ী। একই ভুল হাসিনা সরকার করার ফলও হয়েছে সেই একইরকম- অর্থাৎ পতন। কিন্তু হাসিনা যে ফ্যাসিস্ট সেটা বুঝতে এবং আগামীতে যাতে কেউ ফ্যাসিস্ট না হয়ে ওঠে তা রুখতে ছাত্রদের ফ্যাসিজম সম্পর্কে জানতে হবে বলে মনে করেন এ গবেষক।
২০১০ সালে ফ্যাসিজমের ওপর মার্কিন লেখক জেসন স্ট্যানলির লেখা ‘হাউ ফ্যাসিজম ওয়ার্কস’ বইতে বলা হয়েছে, ফ্যাসিস্ট সরকার সবসময় পৌরাণিক অতীতকে নিজের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। হতে পারে সেটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শ্বেতাঙ্গের জয়জয়কার বা ইসরাইলের নেতানিয়াহুর ইহুদি রাষ্ট্রভূমির প্রচার। ফ্যাসিস্ট জনগণের আবেগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিকে নিজের মনোপলি ব্যবসায় পরিণত করে এবং অতীতের সেই ঘটনাকে পুঁজি করে চেতনার ব্যবসা শুরু করে।
আনোয়ার বলেন, আওয়ামী লীগের সব বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজাকার টেনে আনা এই সময়ে এসে অনেকটা সেকেলে হয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির সবচেয়ে বড় অর্জন কিন্তু এটিকে বারবার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা এবং একমাত্র নিজেদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক ব্যবসায় পরিণত করা ফ্যাসিজমের বহিঃপ্রকাশ।
শুধু আওয়ামী লীগ না বাংলাদেশের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল নিজেদের সোনালি অতীত নিয়ে এতবেশি স্মৃতিকাতর থাকে যে বর্তমানের যেকোনো সমস্যাকে সমাধান না করে অতীতের সুখস্মৃতিকে পুঁজি বানিয়ে সেটি কাটিয়ে যেতে চায়। ছাত্ররা যদি ফ্যাসিজম বিদায় করতে চায় তাহলে সবার আগে এই ধরনের মন মানসিকতাকে বিদায় করতে হবে বলে মনে করেন এ গবেষক।
এবারের গণঅভ্যুত্থানে নিজের আবেগকে প্রকাশ করতে এবং বিপ্লবের ভাষাকে বুঝাতে সামাজিক গণমাধ্যমে মিম এবং কার্টুন এবং শহরের প্রাচীরে গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে নতুন এক হাতিয়ার। এরশাদ পতন আন্দোলনের সময়ে দেয়ালে দেয়ালে চিকামারা কালের বিবর্তনে এসে রূপ নিয়েছে গ্রাফিতিতে।
এ ব্যাপারে চিত্রশিল্প আবিদুর রহমান বলেন, দিনকে দিন গ্রাফিতি সার্বজনীন হয়ে উঠছে। এই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গ্রাফিতি দেশের বিপ্লবের সঙ্গে একই সুতায় গাঁথা হয়ে গেল। গ্রাফিতির স্লোগান, ফেসবুকের মিম বা কার্টুন সবই এক একটি বিপ্লবের ভাষায় রূপ নিয়েছে। ভাষা যে কেবল বাকযন্ত্র নিঃসৃত ধ্বনি নয়, বরং চিত্রকলাও যে একরকমের ভাষা সেটির প্রমাণ এসব গ্রাফিতি।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের দিনগুলোতে নতুন নতুন স্লোগানে মুখরিত ছিল রাজপথ। দিন দিন বদলেছে দাবির ভাষাও। ‘আমি কে তুমি কে, রাজাকার, রাজাকার; কে বলেছে, কে বলেছে, স্বৈরাচার, স্বৈরাচার’- এর মতো প্রতিবাদী স্লোগান একপর্যায়ে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা এক দাবিতে। ‘এক দুই তিন চার, শেখ হাসিনা গদি ছাড়’-এর মতো বজ্রকঠিন স্লোগান ওঠে। শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়, ‘চাইলাম অধিকার হয়ে, হয়ে গেলাম রাজাকার’; ‘আপস না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম’ এবং ‘দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ’-এর মতো আরও অনেক স্লোগান।
সরেজমিনে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের আঁকা এসব গ্রাফিতি সার্কাজম এবং আয়রনিতে ভরপুর, অর্থাৎ রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘুনে খাওয়া জায়গাগুলো নিয়ে সোজাসাপ্টা বিদ্রুপ করছেন তারা। আর এই যে সোজা কথা সোজাসুজি বলা- শিক্ষার্থীরা বলছেন, এবারের গণঅভ্যুত্থানের ভাষাই এটা। এবারের স্লোগানের ছন্দমিল থেকে শুরু করে আন্দোলনের দাবি সবই সোজাসাপ্টা।