সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে উত্তাল আন্দোলনে নিহত হয়েছেন অনেকে। তবে আন্দোলন চলাকালীন সময়ে আন্দোলনকারীদের হাতে পানির বোতল তুলে দেওয়া মুগ্ধর মৃত্যু যেন মানতে পারছেন না কেউই। সোমবার (১২ আগস্ট) মুগ্ধর মৃত্যুর হৃদয়বিদারক বর্ণনা দিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন।
আন্দোলন চলাকালে বিক্ষোভকারীদের হাতে সেদিন পানির বোতল তুলে দিচ্ছিলেন মীর মাহফুজুর রহমান (মুগ্ধ)।
টি-শার্টের হাতা দিয়ে কাঁদানে গ্যাসে জ্বলতে থাকা চোখ মুছতে মুছতেই পানির বোতল বিলিয়ে দিচ্ছিলেন সবার মাঝে। কিন্তু এর মাত্র ১৫ মিনিটের মাথায়, রাজধানী ঢাকায় দুপুরের উত্তাপে বিশ্রাম নেয়ার সময় কপালে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং ফ্রিল্যান্সার মুগ্ধ।
কপালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মুগ্ধকে তার বন্ধু এবং অন্য বিক্ষোভকারীরা উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। মুগ্ধর যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান (স্নিগ্ধ) সিএনএনকে বলেন, ‘আমি শুধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম এবং কান্নায় ভেঙে পড়ি। ’
আন্দোলনের শুরুর দিকে ১৮ জুলাই উত্তরার আজমপুরে মুগ্ধর ‘পানি লাগবে পানি’ বলে পানি বিতরন করছিলেন মুগ্ধ। তার কিছু পরেই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। মুহুর্তেই সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে মুগ্ধর পানি বিতরনের ভিডিওটি, যা শেয়ার করেন লাখ লাখ মানুষ। এই ভিডিও আন্দোলনে চরম উত্তাপ ছড়িয়ে দেয়। এই হত্যাকান্ড এবং ন্যায়বিচারের আহ্বান জানিয়ে হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে পড়ে।
সরকারি চাকরির জন্য কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের সূচনা পরবর্তীতে দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য দেশব্যাপী আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। স্থানীয় মিডিয়া এবং বিভিন্ন সংস্থার বরাত দিয়ে সিএনএন উল্লেখ করে, এ ঘটনায় সংঘর্ষে অন্তত ৩০০ জন নিহত হয়।
২৩ বছর বয়সি ফারাহ পরশিয়া ঢাকার একটি প্রযুক্তি কোম্পানিতে কর্মরত এক বিক্ষোভকারী ছিলেন। তিনি সিএনএনকে বলেন, হত্যাকাণ্ড চলছিল এবং সবাই নীরব ছিল। ফলে আমাদের নিজেদের জন্য এবং গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য দাঁড়াতেই হতো।
ফারাহ আরও বলেন, ‘আমরা (সাধারণ মানুষ) যে কতটা ক্ষমতা ধারণ করি, তা দেখে আমি অবাক হয়েছি। কারণ, বহু বছর ধরে আমরা সবাই ক্ষমতাহীন বোধ করে এসেছি। ’
আন্দোলন চলাকালীন সময়ের বিশৃঙ্খলা শান্ত হয়ে আসায় প্রিয়জনের মৃত্যুর অনেক পরিবারই এখন বিচার চাইছেন।
যমজ দুই ভাই মুগ্ধ এবং স্নিগ্ধ যেন জন্ম থেকেই ছিলেন অবিচ্ছেদ্য; খাওয়া, ঘুম, এক সঙ্গে পড়াশুনা থেকে শুরু করে পোশাক ভাগাভাগি করতেন তারা।
স্নিগ্ধ বলেন, “তিনি শুধু আমার ভাই ছিলেন না, তিনি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলেন, তিনি আমার শরীরের একটি অঙ্গ। ” “আমরা একসাথে সবকিছু করতাম। “
মুগ্ধ ছিলেন গণিতে স্নাতক, পড়ছিলেন এমবিএ। তার যমজ ভাই পড়ছিলেন আইন নিয়ে। দুই ভাই মিলে স্বপ্ন দেখতেন মোটরসাইকেলে করে ইউরপ ঘুরে বেড়ানোর।
ভ্রমণের জন্য অর্থ সঞ্চয় করতে দুই ভাই অনলাইন ফ্রিল্যান্সার হাব ফাইভারের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং করতেন। কিন্তু মুগ্ধকে ছাড়াই এখন একলা চলতে হচ্ছে স্নিগ্ধকে। ভাইয়ের সাথে স্বপ্ন পূরণ আর হয়নি স্নিগ্ধর।
মুগ্ধর মৃত্যুর সময় তার গলায় ঝুলছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড। অন্ধকার দিনের প্রতীক হিসেবে শুকিয়ে যাওয়া রক্তমাখা আইডি কার্ডটি সযত্নে রেখে দিয়েছে তার পরিবার। আন্দোলনে মুগ্ধ যে প্রভাব ফেলেছে, তা থেকেই সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করছেন তারা।
মানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল মুগ্ধর মৃত্যু। সিএনএনকে স্নিগ্ধ বলছিলেন, “তার ( মুগ্ধ) কারণে, মানুষ প্রতিবাদ করার শক্তি পেয়েছে,”। “তিনি সবসময় বলতেন যে ‘আমি আমার বাবা-মাকে একদিন গর্বিত করব। সেই মুহূর্তটি এসেছে। “
স্বৈরশাসনের পতন হয়েছে। তরুনদের হাত ধরে নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে দেশের কোটি মানুষ। মুগ্ধরা নতুন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। তবে তাদের অবদান বৈষম্যহীন নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে দেশের মানুষকে।