কার্জন হলের পূর্ব পাশ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) এলাকায় ঢোকার পর দোয়েল চত্বরে কিছু পাখির দেখা মিলল। সড়কের ওপর ওড়াউড়ি করছিল এগুলো। ঝকঝকে দুপুরে নির্জন ক্যাম্পাসে পাখির কিচিরমিচির ছাড়া আর কিছু নেই। কিছুদূর যাওয়ার পরই ঢাকা মেডিকেল কলেজের গেটে সতর্কভাবে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ। শহীদ মিনার চত্বরে বিজিবি সদস্যরা বসে আছে। চারদিকে একটা থমথমে নীরবতা।
সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই) দুপুর ১২টা। এ সময়ে চারপাশ শতশত শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত থাকার কথা। রাস্তাজুড়ে থাকত বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাস। শিক্ষার্থীরা হুড়োহুড়ো করে ক্লাসে যাওয়ার তাড়নায় থাকতেন। গ্রন্থাগার থাকার কথা ছিল পড়ুয়া শিক্ষার্থীতে ভরপুর।
কিন্তু পুরো ক্যাম্পাসে দুই ঘণ্টা ঘোরার পর এক অদ্ভুত শূন্যতা ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না। পুরো টিএসসিজুড়ে বিজিবি সদস্যরা বসে আছেন। সেখানে জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ সড়ক বিভাজকে মেট্রোরেলের কলামে গা এলিয়ে দিয়ে বসে রয়েছেন। কিছু সাংবাদিকও অপেক্ষা করছিলেন ঘটনার অপেক্ষায়।
কিছু দূর যাওয়ার পর ভিসি চত্বরের রেইন ট্রি গাছের নিচে ‘স্মৃতি চিরন্তনে’ পুলিশ সদস্যদের দেখা গেছে। আজহার নামের এক পুলিশ সদস্য বললেন, ‘তিনি সকাল থেকে এখানে দায়িত্ব পালন করছেন। এরমধ্যে কোনো শিক্ষার্থী তার চোখে পড়েনি। রাতের বেলায় কী ঘটেছে, তা তিনি বলতে পারছেন না।’
কলাভবনের মূল ফটক বন্ধ। মূল চত্বর দখল করে আছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। ভিসি চত্বর পার হয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে গিয়ে দেখা গেল মূল ফটকে তালা দেয়া। ভেতরে দুই প্রহরী বসে আছেন।
জহুরুল হক হলের ভেতরে গিয়ে দেখা গেল ছাত্রদের থাকার কক্ষগুলোর দরজা-জানালা ভাঙা। বাইরে দড়িতে ঝোলানো তাদের জামা-প্যান্ট। হল ছাড়ার আগে এগুলো গুছিয়ে ভেতরে রাখার সুযোগ হয়নি।
হল প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গতকাল বুধবার (১৮ জুলাই) বিকাল চারটা থেকে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে ছাত্ররা হল থেকে বেরিয়ে যান। তার আগেও অনেকে বেরিয়ে চলে গেছেন।’
বুধবার দুপুরে সিন্ডিকেট সভার পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে ছাত্রদের হলত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনার আগেও কিছু শিক্ষার্থী হল ছেড়েছেন।
সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের প্রাধ্যক্ষ্য আব্দুর রহিম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে ছাত্ররা নিজেদের মতো করে বেরিয়ে গেছেন। কোনো বলপ্রয়োগ ছিল না। শুরুতে কেউ কেউ বলছিলেন আমরা যাব না। তারা নিজেরা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু যখন সব ছাত্র চলে যান, তখন তারা আর থাকেননি।’
কোটা আন্দোলনে হলের পাঁচ-ছয়জন ছাত্র আহত হয়েছেন বলেও জানান তিনি। এই প্রাধ্যক্ষ বলেন, তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। তাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।’
ছাত্ররা যেভাবে বেরিয়ে যান
বুধবার সারাদিন খুব ভয়াবহ পরিস্থিতি ছিল জানিয়ে হলের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যেখানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সদস্য ছিল ৫০ জন, সেখানে কোটা আন্দোলনকারীরা সংখ্যায় ছিলেন ৫০০ জন। যে কারণে ছাত্রলীগ সাহস করেনি, তারা হল ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।’
ছাত্রলীগ কর্মীদের আচরণে শিক্ষার্থীরা আগে থেকেই অতিষ্ঠ ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যে কারণে হল ছাত্রলীগের একটা বড় অংশই কোটা আন্দোলনে যোগ দেয়। এতে সংখ্যায় কমে যায় ছাত্রলীগ।’
হলের পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ ছিল
শিক্ষার্থীদের হল ছাড়তে বাধ্য করতে আগেই হলের পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কবি জসিমউদ্দিন হলের এক কর্মকর্তা বলেন, বুধবার থেকেই ঢাবির সব হলের পানি ও বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যে কারণে ছাত্ররা থাকতে চাইলেও হলে থাকতে পারতেন না।
তিনি বলেন, ‘ছাত্রদের সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে হল ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে। যে কারণে যে যে অবস্থায় ছিলেন, তারা সেই অবস্থায় বেরিয়ে গেছেন।’
জসিম উদ্দিন হলের ভেতরে যেতে চাইলে প্রাধ্যক্ষ ড. শাহিন খানের অনুমতি মেলেনি। ফোনে তিনি বলেন, ‘হলে তালা মারা। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারছেন না। কর্মকর্তাদের কাছে চাবি নেই।’
যদিও এই প্রতিবেদকের সামনে দিয়ে হলের ভেতরে যাতায়াত করছিলেন সেখানকার কর্মকর্তারা।
স্যার পিজে হার্টস ইন্টারন্যাশনাল হলের প্রাধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান খান বলেন, চাকরিপ্রত্যাশীদের আন্দোলনে আমি ব্যক্তিগতভাবে একমত। তাদের দাবি যৌক্তিক ও ন্যায্য বলে মনে করছি। এ আন্দোলনের সঙ্গে আমরা সমর্থন দিয়েছি। সরকারের কাছে একটা যৌক্তিক ও ন্যায্য সমাধান দাবি করেছি।
কোটা আন্দোলন এখন আর শান্তিপূর্ণ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একটি দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বলা হলো যে এটাকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। তাদের ছাত্র সংগঠনকে এক ধরনের নির্দেশনা দেয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন একটা সহিংসতার দিকে গেছে।’
এখন দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত বলেও মন্তব্য করেন এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি কখনও কাম্য ছিল না, এটা এড়ানো যেত। কিন্তু রাজনৈতিক আধিপত্যবাদী মনোভাব থাকলে যা হয়, সেটাই হয়েছে এখন দেশে।’