রঞ্জন কুমার দে, শেরপুর, বগুড়া।।
জন্মদিনের উৎসব, বিয়ে বাড়ি কিংবা গ্রামীন মেলায় দেখা মেল কিছু যুবক যুবতীর। নেচে গেয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জন করেন তারা। সাধারণ ভাবে তারা বিচিত্রা শিল্পী হিসেবে পরিচিত। পেশার মতোই বিচিত্র তাদের জীবন। মঞ্চের উচ্চ শব্দ ও রঙ্গীন ঝিলিমিলি আলোয় ক্ষণিকের জন্য মিলিয়ে যায় তাদের বেদনা। কিন্তু দিন শেষে সমাজের মানুষের কাছে রয়ে যায় অস্পৃশ্য।
কিছু দিন আগে বগুড়ার শেরপুরে কেল্লা পোশী মেলায় কথা হয় কিছু বিচিত্রা শিল্পীদের সাথে। তারা অকপটে বলে যান জীবনের গল্প। গ্রামীন ঐতিহ্য যাত্রা শিল্প বন্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। কিন্তু পেশা পরিবর্তন করতে পারেনি শিল্পীরা। তারা বিভিন্ন নাট্য বা শিল্প গোষ্ঠী হিসেবে টিকে থাকলেও মূলত গ্রামীন মেলায় হাজির হন নাচ গানের বিচিত্রা প্রদর্শনীতে। প্রশাসনের অনুমোদনহীন এই পেশায় অর্থ মিললেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তারা। বড় পর্দার সেলিব্রেটিদের মতো তরাও প্রান্তিক মানুষের মনোরঞ্জন করেন। কিন্তু আত্ম সন্মান নিয়ে জীবন যাপন করতে পারেন না বলে তাদের আক্ষেপ।
এই পেশায় নতুন নারীদের যুক্ত হওয়ার ঘটনাগুলোও মনে করিয়ে দেয় সমাজের নানান বৈষম্য ও অসঙ্গতির কথা। কেউ স্বামীর কাছে তালাক প্রাপ্ত হয়ে, কেউ নেশাগ্রস্ত পিতা ও বিমাতার অত্যাচারে, আবার কেউ প্রেমিকার দ্বারা প্রতারিত হয়ে বেছ নিয়েছেন এই পেশা। বিভিন্ন দলের সাথে মেলায় মেলায় ঘুরে বেড়ান। এরজন্য যে টাকা পাওয়া যায় তাতে কোন রকমে জীবন চলে। কিন্তু জীবন তাদের অভিশাপ্ত। তারা স্বপ্ন দেখেন নিজে প্রদীপ হয়ে জ্বলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জীবন আলোকিত করার।
বিচিত্রা শিল্পী ময়না খাতুনের (২৮) বাড়ি পাবনার হান্ডিয়াল উপজেলায়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে হয়। তার ছেলে ও মেয়ের জন্মের পর স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ ঘটে। আবারও বিয়ে করেন। কিন্তু নতুন স্বামী তার সন্তানদের দায়িত্ব নেননি। তাই তার স্কুল জীবনের শখের নাচ ও গান সম্বল করে নাম লেখান বিচিত্রা শিল্পীর খাতায়।
সিরাজগঞ্জের সুমি আক্তার (৩০) শিশুকালেই মাকে হারিয়েছেন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে শুরু হয় নির্যাতন। তাই লেখাপড়া করতে পারেননি। বিয়ের পর স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দুই সন্তানকে নিয়ে ঘর ছেড়েছেন। শুরু করেন গার্মেন্টেসের চাকরি। সেখানে একজন পরিচিত মেয়ের মাধ্যমে এই জগতে প্রবেশ করেন।
সুমি বলেন, “আমার বড়ো ছেলেটা এখন ১৪ বছরের। পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। তাকেও বিভিন্ন জায়গায় আমার জন্য ছোট হতে হয়। সামজিক মর্যাদা হারিয়েছি। সমাজে কেউ মেনে নিতে চায় না। কিন্তু আমি নিরুপায় হয়ে এই পেশায় পড়ে আছি।”
বগুড়ার শেরপুরের রিয়া (১৯) জানান, শৈশবে তার মা মারা গেছেন। বাবা নেশাগ্রস্ত। দাদীর সহযোগীতায় নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। এরপর তার বিয়ে হয় বিচিত্রা দলের এক সদস্যের সাথে। এখন তিনি স্বামীর সাথেই বিভিন্ন মেলায় নাচ গান করেন। দর্শকদের অশালীন অঙ্গভঙ্গী ও কথা উপেক্ষা করেই তাদের চলতে হয়।
বিচিত্রা মঞ্চে যারা নাচগান করেন তাদের শিল্পী হিসেবে মর্যাদা দিতে নারাজ অনেকেই। অশ্লীলতা ও অপসংস্কৃতির অভিযোগে সাধারণ ভাবে এসব অনুষ্ঠানের অনুমতিও মেলে না। অনেকটা অবৈধভাবেই চলে এসব। এ নিয়ে তাদের আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন অনেক শিল্পী।
নারায়নগঞ্জের সাথী আক্তার বলেন, “নাচ গান আমাদের পেশা। আমরা সরাসরি দর্শকদের সামনে নাচি। অনেকই আমাদের পোষাক ও চরিত্র নিয়ে বাজে কথা বলেন। কিন্তু আমি মনেকরি অনেক চলচ্চিত্র শিল্পীদের চেয়ে আমরা শালীন পোশাক পড়ি। আর চরিত্র খারাপের মানুষ যেকোন পেশাতেই থাকতে পারে। তাই সাবইকে এক চোখে দেখা ঠিক না। আসলে বিষয়টা হচ্ছে তারা ধনীদের জন্য নাচে, আর আমরা নাচি গরীবদের সামনে।”
কথা হয় এক বিচিত্রা দলের ম্যানেজার আকাশের (৩২) সাথে। তিনি জানান, প্রশাসনের অনুমতি না থাকায় সাধারণত প্রভাবশালীরাই আমাদেরকে নিয়ে আসেন। অনেক সময় মঞ্চ ভেঙ্গে দেওয়া হয়। আবার কখনও কখনও উচ্ছৃঙ্খল দর্শক মেয়েদের উত্যাক্ত করে। আমরা তখনও নিরাপত্তা পাইনা। আর শো চালাতে না পারলে আয়োজকরাও টাকা দেয় না। কিন্তু শিল্পীদের ঠিকই টাকা দিতে হয়। আসলে আমাদের এই পেশা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।”
বিচিত্রা মঞ্চের নাচ গানকে উপভোগ করাকে অনেকটা নিষিদ্ধ মনেকরেন দর্শকরা। তাই যতটা সম্ভব দর্শকের সাড়িতে নিজেকে আড়াল করে থাকতে চান। কিন্তু ভালো লাগার টানে বার বার ছুটে যান তারা।
শেরপুর উপজেলার কেল্লা গ্রামের মোখলেছুর রহমান (৩৫) বলেন,”বিচিত্রা প্যান্ডেলে আমার চেয়ে ছোট ও বড় বয়সী দর্শক থাকে। সাবাই শিল্পীদের নাচ দেখতে যায়। অনেক পরিচিত মানুষও থাকে। তাই নিজেকে আড়াল করতে অনেকের মতো আমিও মুখোশ পড়ে থাকি। কারন নিজের মধ্যে অপরাধ বোধ কাজ করে।“
শুভগাছা গ্রামের আব্দুল মমিন বলেন,”আসলে বিচিত্রা অনুষ্ঠান অনেকটা নিষদ্ধ সিনেমার মতো। তাই এই পেশার শিল্পীদের সবাই খারাপ চোখেই দেখে।”
সমাজ-সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মানস চৌধুরী বলেন,”বিচিত্রা শিল্পীদের বর্তমান দুরবস্থা কয়েকটা বিষয়ের ফলাফল। তবে বেশি আলোচিত হয় ‘চরিত্র’ ও ‘রুচি’র প্রসঙ্গ। এখন ‘চরিত্র’ সংক্রান্ত যৌনাত্মক ধারণা নিয়ে বিশদ আলাপের জায়গা নেই। আপাতত বলি, যাত্রাশিল্পের শেষ পর্যায়ে এসেও যাত্রাশিল্পীদের করুণ অবস্থা ছিল। পুরুষ শিল্পীদের একভাবে, নারীশিল্পীদের আরেকভাবে। নতুন পুঁজিবাদে যাত্রা (ও সার্কাস) সর্বাত্মক বিলুপ্তির মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদের প্রথম দশার এসব শিল্পীরা বস্তুত উৎখাত হলেন তাঁদের জীবিকা থেকে, যে জীবিকাও ছিল কোনোমতে চলা। সমাজের শ্রেণিবিন্যাস ও শ্রেণি-ঘৃণা ছাড়া কেবল কলা ও তার স্বীকৃতি দিয়ে আমি বুঝতে মানা করব। একই ‘লোকগান’ সক্ষম শ্রেণির লোকে গাওয়া আর গরিবমানুষে গাওয়ার পার্থক্য দিয়েই বোঝা সম্ভব। ফলে সম্মানের বা স্বীকৃতির বিষয়টা আমি বুঝলেও, সংকটটা দেখি গরিবিতে।”