কেউ ঘুরে ঘুরে গরু দেখছেন, কেউ দরদাম করছেন, কেউবা দাম চুকিয়ে গরু নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিচ্ছেন। তবে সবার চোখ এক নারী বিক্রেতার দিকে। পরম মমতায় লালন-পালন করা গরুগুলোকে দেখাশোনা করছেন। কখনও খাওয়াচ্ছেন আবার কখনও গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। এর ফাঁকে গরুর দাম হাঁকাচ্ছেন।
শুক্রবার (১৪ জুন) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের বিবিরহাট বাজারে দেখা হয় সেই নারী বিক্রেতার সঙ্গে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নাচোল ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামের সালমা খাতুন ১৪টি গরু নিয়ে এই হাটে এসেছেন।
চাকরি হারিয়ে স্নাতক পাস সালমা বাড়ির পাশেই গড়ে তোলেন ছোট্ট খামার। গত বুধবার ১৪টি গরু নিয়ে তিনি বাড়ি থেকে দূরের বন্দরনগরে এসেছেন। এবারের কোরবানির ঈদে গরু নিয়ে আসা একমাত্র নারী বিক্রেতা। তাই তাকে ঘিরে ইতোমধ্যেই আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।
৩৪ বছর বয়সী সালমা খাতুন শোনালেন নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার গল্প। সালমা জানালেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ থেকে দর্শনে স্নাতক করেছেন। এরপর ভর্তি হন রাজশাহী কলেজে। সেখান থেকে ২০১৬ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন। তবে করোনাকালে এসে চাকরিটা বাঁচানো যায় নি।
তিনি বলেন, ‘চাকরি হারিয়ে হতাশ হয়ে ঘরে বসে থাকিনি। কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া যায়- সারাক্ষণ সেই ভাবনাই ভাবতাম। এর মধ্যে গবাদিপশুর খামার করার চিন্তা মাথায় আসে। জমানো টাকায় একটি গাভি কিনি। শুরুর দিকে দুধ বিক্রি করতাম। এরপর গাভি থেকে আরও দুটি গরু প্রস্তুত হয়। এভাবেই খামার বড় করার চিন্তা আসে।’
এক গাভি থেকে ডজনেরও বেশি গরুর খামার গড়ে তোলার গল্পও শোনালেন সালমা। তিনি বলেন, ‘সোনালী ব্যাংক স্থানীয় শাখা থেকে ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে খামারে ১০টি গরু তুলেছিলাম। দুই বছরের মাথায় সব মিলিয়ে ২০টি গরু ও বাছুর দাঁড়াল। পরে ২০২২ সালের ঈদে ১০টি গরু নিয়ে প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামের বিবিরহাটে আসি। ঈদের আগের দিন সব কটি বিক্রি হয়ে যায়।’
২০২৩ সালে ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে খামারে তেমন সময় দিতে পারেননি সালমা খাতুন। এ জন্য গরুর পরিচর্যাও ঠিকঠাক হয়নি। স্থানীয়ভাবেই গরু বিক্রি করেছিলেন। প্রথমবারের মতো লোকসানের মুখোমুখি হন তিনি। তবে হাল ছাড়েননি।
সালমা জানান, বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক চাঁপাইনবাবগঞ্জ শাখা থেকে ৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আবার শুরু করেন গরু লালন-পালন। এ বছর ঈদ উপলক্ষে প্রস্তুত করেছেন ১৪টি গরু।
প্রায় ৫৭০ কিলোমিটার দূরের পথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে এসে গরু বিক্রি করার বিষয়ে প্রশ্ন ছিল সালমা খাতুনের কাছে। জবাবে তিনি জানান, চট্টগ্রামে ছোট-মাঝারি গরুর চাহিদা বেশি। এ ধরনের গরু নিয়ে তাদের এলাকার অনেক ব্যাপারীই প্রতিবছর চট্টগ্রামে আসেন। এ ছাড়া ২০২২ সালে তিনি সব কটি গরু ভালো দামে বিক্রি করতে পেরেছিলেন। তাই এবারও চট্টগ্রামের বিবিরহাট পশুর বাজার বেছে নিয়েছেন।
নিজ জেলা থেকে দূরের আরেকটা জেলায় গরু নিয়ে আসতে মনে ভয় কাজ করেছে কিনা, জানতে চাইলে এই গরু খামারি বলেন, ‘মনে সব সময় সাহস রাখি। কোনও কিছুরেই ভয় পাই না। সাহস হারাই না কখনও। তাই এত দূরের পথও দূরে মনে হয়নি।’
ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে সালমা জানান, তার একটি মাত্র কন্যা সন্তান। ২০১৩ সালের দিকে যখন তার মেয়ের জন্ম হলো, তার পরপরই স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে যায়। বাবার বাড়িতে থেকে পারিবারিক জমিতেই তিনি খামার গড়ে তোলেন। কিছু জমি বন্ধক রেখে স্বল্প সুদে ঋণ নিয়েছেন। গরু বিক্রির টাকায় ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করছেন। মেয়েও বড় হয়ে যাচ্ছে। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী সে। ফলে সব মিলিয়ে এখন ভালোই আছেন তিনি।
সালমা গরুগুলো হাটে তুলেছেন, তবে লালন-পালন করতে করতে গরুগুলোর প্রতি তার ভীষণ মায়া জন্মে গেছে। তিনি বলেন, ‘জীবনে যতবারই হতাশা এসেছে, ততবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এ খামারে গরু লালন-পালন করতে করতে হতাশায় ভুলে থাকি।’
সালমা রাত ২টা পর্যন্ত হাটে থাকছেন। এরপর বাজারের পাশের একটি বাসায় গিয়ে ঘুমান। আবার সকাল বেলায় হাটে এসে গরুর খাবার তৈরি করেন।
নারী উদ্যোক্তা সালমাকে বাজারের অন্য ব্যাপারীরাও সহযোগিতা করছেন। এ কারণে তিনি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।