চীনে শত শত মসজিদ বন্ধ করে দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। আবার কোথাও কোথাও মসজিদের ব্যাপক অবকাঠামো ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এই ধারাবাহিকতায় আরব ধাঁচে নির্মিত একটি বড় মসজিদের চেহারাই পাল্টে ফেলা হয়েছে। গম্বুজ ও মিনার অপসারণ করে সেখানে যুক্ত করা হয়েছে চীনা ধাঁচের ছাদ।
দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন মতে, চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের ছোট্ট শহর শাদিয়ান। শহরের সবচেয়ে বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ মসজিদ শাদিয়ান গ্র্যান্ড মসজিদ। চীনে আরব বৈশিষ্ট্যের সর্বশেষ প্রধান মসজিদ এটি।
সম্প্রতি মসজিদটির আমূল সংস্কার করা হয়েছে। সংস্কারের অংশ হিসেবে এর গম্বুজ ও মিনারগুলো সরিয়ে সেখানে চীনা ধাঁচের ছাদ বসানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মধ্যদিয়ে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপাসনালয়গুলোর চীনাকরণ করার সরকারি অভিযান সম্পন্ন হলো।
গত বছর পর্যন্তও ২১ হাজার বর্গমিটার আয়তনের মসজিদ ভবনটির ওপর সবুজ গম্বুজ শোভা পাচ্ছিল। যার চূড়ায় ছিল একটি অর্ধচন্দ্র আর চারপাশে উঁচু মিনার সজ্জিত চারটি ছোট গম্বুজ। ২০২২ সালের স্যাটেলাইট চিত্রেও দেখা যায়, মসজিদের প্রবেশপথটি উজ্জ্বল কালো টাইলসের তৈরি একটি বড় অর্ধচন্দ্র ও তারকা দিয়ে সজ্জিত।
অথচ চলতি বছরের স্যাটেলাইট চিত্রে দেখা যায়, মসজিদটি গম্বুজ ও মিনার অপসারণ করা হয়েছে এবং সেই জায়গায় চীনা ধাঁচের প্যাগোডার ছাদ বসানো হয়েছে। মসজিদের সামনে-পেছনের উঁচু চারটি মিনার সরিয়ে সেখানে অপেক্ষাকৃত ছোট প্যাগোডা টাওয়ার বসানো হয়েছে।
শুধুমাত্র মসজিদের প্রবেশপথের টাইলসের অর্ধচন্দ্র ও তারকা শেষ চিহ্ন হিসেবে দৃশ্যমান রয়েছে। মসজিদের আগে ও পরের ছবির দিকে তাকালে এটা যে একই মসজিদের ছবি তা বুঝতে যে কারও কষ্ট হবে।
শাদিয়ান থেকে ১০০ মাইলেরও কম দূরত্বে অবস্থিত ইউনানের আরেক ঐতিহাসিক মসজিদ নাজিয়ায়িং মসজিদও সম্প্রতি সংস্কারের মাধ্যমে আরব বৈশিষ্ট্যগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
গত বছর যখন চতুর্দশ শতকের মসজিদটির একটি অংশ ভেঙে ফেলা হচ্ছিল, তখন শত শত মুসল্লি এর প্রতিবাদ জানায়। ওই সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে।
২০১৬ সাল থেকেই ক্ষমতাসীন চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) চীনে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু বিশেষ মুসলিমদের ওপর কঠোর চাপ বজায় রেখেছে। সেই সময় চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ধর্মকে চীনাকরণের নির্দেশ দেন। এরপর থেকেই মসজিদের সংখ্যা হ্রাস বা তা পরিবর্তন করা হচ্ছে।
২০১৮ সালের এপ্রিলে চীন সরকার ইসলামভিত্তিক ধর্মীয় স্থাপনা নির্মাণ এবং বিন্যাস কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করে। পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল ‘বিদেশি স্থাপত্যশৈলী’ প্রতিরোধ করা এবং ইসলামি স্থাপত্যগুলো চীনা বৈশিষ্ট্যে রূপ দেয়া।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ফাঁস হওয়া একটি মেমোতে দেখা গেছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ‘বেশি বেশি ভেঙে ফেলার এবং কম নির্মাণের নীতি মেনে চলার’ নির্দেশ দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ রুসলান ইউসুপভ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে যে ‘ইসলামের চীনাকরণ’ অভিযান চলছে, এই বড় দুটি মসজিদের আমূল পরিবর্তন তার বড় দৃষ্টান্ত। গ্রামে থাকা আরব রীতির ছোট ছোট মসজিদ এখনও অবশিষ্ট থাকলেও স্থানীয় সম্প্রদায়ের পক্ষে সেগুলোর চীনাকরণের বিরোধিতা করা কঠিন হবে।
চীনের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ইতিহাসের শিক্ষক ও ইতিহাসবিদ হান্নাহ থেকার বলেন, মসজিদের চীনাকরণ অভিযান সবগুলো প্রদেশে এগিয়ে চলেছে। বেইজিংয়ের অন্যতম দূরবর্তী প্রদেশ ইউনানকে সর্বশেষ অভিযান চালানো হয়েছে। নিউইয়র্কভিত্তিক চীনা অধিকারকর্মী মা জু বলেন, চীনা সরকারের এই সংস্কার ‘ধর্ম ও জাতিসত্তা ধ্বংস করার একটি স্পষ্ট বার্তা’।