এবার ভারতের সাধারণ নির্বাচনে প্রায় একশ কোটি মানুষ ভোট দিচ্ছেন। ইতিহাসে কোন নির্বাচনে এত মানুষের ভোট দেয়ার ঘটনা এটিই প্রথম। আবার এই নির্বাচনের ব্যয়ও হতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি। ভারতের সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ (সিএমএস) অনুসারে এই নির্বাচনের খরচ হতে পারে ১ দশমিক ৩৫ ট্রিলিয়ন রুপি বা ১ হাজার ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার। যা ২০১৯ সালে ভারতের নির্বাচনের খরচের দ্বিগুণেরও বেশি। এমনকি ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের খরচকেও ছাড়িয়ে যাবে ভারতের এবারের নির্বাচনী ব্যয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, নির্বাচনে কেন ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে?
শুধু দেশটি বড়, এটাই একমাত্র কারণ নয়। আরও বেশ কিছু কারণ আছে এর পেছনে। এটা ঠিক যে, বড় দেশ তাই ভোটারের সংখ্যাও বেশি। আর এত বেশি ভোটারের কাছে পৌঁছাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাই খরচও করতে হয় বেশি। তবে ভারতের ভোটারের সংখ্যার চেয়ে এর নির্বাচনী ব্যয়ের অঙ্কটা আরও অনেক বড়। গত দুই দশকে, নির্বাচনী ব্যয় ১৬৫ শতাংশ বেড়েছে। অথচ একই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৭ শতাংশ।
এর পেছনে আরেকটি ব্যাখ্যা হলো, প্রার্থীর সংখ্যা। ২০১৯ সালের নির্বাচনে ১ টি আসনের জন্য গড়ে ১৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। এবারের নির্বাচনেও সংখ্যাটাও প্রায় একই। প্রতি আসনের জন্য লড়ছেন ১৫ জন প্রার্থী। যা প্রচারণা বা নির্বাচনী ব্যয় বাড়ার আরেকটি কারণ।
সিএমএস-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের নির্বাচনে অর্ধেকেরও বেশি পার্টি এবং প্রার্থীর ব্যয়ের একটা বড় অংশ চলে গেছে বিজ্ঞাপন, দলীয় কর্মীদের মজুরি এবং পরিবহন খরচ মেটাতে। যেহেতু ভারতের অর্থনীতি বাড়ছে, তাই ভোটারদের জীবনযাত্রার মানও উন্নত হচ্ছে।
তাই ভোটারদের চাহিদার কথাটাও মাথায় রাখতে হচ্ছে রাজনীতিবিদদের। তাদের নিজেদের দিকে টানার জন্য নেতারা পরিশীলিত ও চটকদার অনেক উপায় বেছে নিচ্ছেন যা অনেক সময় ব্যয়বহুলও বটে। এখন ডিজিটাল বিপণনে অনেক বেশি ব্যয় করা হচ্ছে। গুগলের ডাটা বলছে, এবারের নির্বাচনের আগের মাসগুলোতে বিজ্ঞাপনের পেছনে যে ব্যয় করা হয়েছে, তা ২০১৯ সালের নির্বাচনের তুলনায় ৬গুণ বেশি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো, ভোটারদের জন্য মিষ্টি কেনা বাবদ ব্যয়। এই ব্যয়গুলো কখনই হিসাবে ধরা হয় না। তবে সিএমএসের তথ্য অনুসারে, ২০১৯ সালে রাজনৈতিক ব্যয়ের প্রায় এক চতুর্থাংশ চলে গেছে ভোটারদের জন্য উপহার কিনতে। এই উপহারের মধ্যে আছে মদ, কখনও টেলিভিশন বা কখনও ছাগল কিনে দেয়া। অথবা ক্যাশ রুপি। দক্ষিণ ভারতের চারটি জেলার অর্ধেকেরও বেশি ভোটারকে তাদের একটি ভোটের জন্য ১০০০ থেকে ২০০০ রুপি দেয়া হয়েছিল।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনিফার বাসেল পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতের ৮০ শতাংশ প্রার্থী জানান যে, ভোটারদের উপহার দিতে গিয়ে তারা বেশিরভাগ সময় চাপে পড়ে যান।
তবে ভারতের নির্বাচনী আইনে, ভোটারদের এত বড় বড় উপহার দিয়ে নিজের দলে টেনে আনাটা অবৈধ। ১৫ এপ্রিল ভোট শুরুর এক সপ্তাহ আগে, নির্বাচন কমিশন বলেছিল যে, তারা ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নিশ্চিত করার জন্য অভিযান চালিয়ে নগদসহ ৪ হাজার ৭০০ কোটি রুপির উপহার সামগ্রী জব্দ করেছে। এই জব্দ করা মালামালের মধ্যে রয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ লিটার অ্যালকোহল এবং নগদ ৪০০ কোটি রুপি। এটি একটি আংশিক চিত্র মাত্র। আসলে প্রার্থীরা নির্বাচনের সময় যে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন তা কল্পনাও করা যায় না।
প্রচারণার সময় খরচের এই বাড়াবাড়ি পরবর্তীতে যিনি নির্বাচিত হন তাকে প্রভাবিত করে। জয়ী হওয়ার পর নেতাদের মধ্যে খরচের ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার মনোভাব তৈরি হয়। জরিপে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে বিজয়ী প্রার্থীদের সম্পদের হিসাব বিবরণীতে ছিল ৪ কোটি রুপি। কিন্তু প্রচারণায় তাদের খরচ হয়েছে তার প্রায় ১৬ গুণ বেশি। আর বেশিরভাগ সময়ই দেখা যায়, তারা যে খরচ করেন তা বৈধ উপায়ে উপার্জন করা নয়।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বেশিরভাগ নেতার ভাবমূর্তি স্বচ্ছ নয়। তাদের অতীত জীবন ঘাঁটলে দেখা যায়, তারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এই সমস্যা শুধু ভারতের নয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও ‘ক্যাশ ফর ভোট’ চালু আছে। তবে কীভাবে অর্থ এবং রাজনীতির সম্পর্ককে দুর্বল করা যায় তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ভারতীয় কর্মকর্তারা।
২০১৮ সালে সরকার অনুদানের জন্য একটি আইনি চ্যানেল দিয়ে রাজনীতিতে ‘কালো টাকার’ প্রবাহকে রোধ করার জন্য একটি ‘নির্বাচনী বন্ড’ প্রকল্প চালু করেন। কিন্তু অনুদান বেনামী হওয়ায় এই প্রকল্পটিকে কার্যকর করা যাচ্ছে না। এমনকি ফেব্রুয়ারি মাসে সুপ্রিম কোর্ট এই উদ্যোগটিকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন।
সত্যি বলতে কি, ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি এ বিষয়ে তেমন কোন জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। যার কারণে ২০১৯ সালের নির্বাচনী ব্যয় দাঁড়িয়েছে ধারনার চেয়েও অনেক বেশি। এবং সম্ভবত এই নির্বাচনে আবারও একই ঘটনা ঘটবে।