যে কোনও সময় আন্তর্জাতিক উদার ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এমনভাবে ভেঙে পড়বে যেটা আর আগের অবস্থায় ফিরবে না। এমনকি নতুন কোনও ব্যবস্থাও তার স্থলাভিষিক্ত করা যাবে না।
সাদা চোখে দেখলে বিশ্ব অর্থনীতি স্থিতিশীল আছে বলেই মনে হচ্ছে। যুদ্ধ ও মহামারির ধাক্কা ভালোভাবেই হজম করছে বিশ্ব। চীনের সাথে ভয়াবহ বাণিজ্যযুদ্ধ সত্ত্বেও মার্কিন অর্থনীতি চাঙ্গা রয়েছে। সরাসরি রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকলেও সেই ক্ষতি ভালোভাবেই পুষিয়ে নিয়েছে জার্মানি- তাদের কোনও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়নি।
তেল সরবরাহে কোনও বাধা তৈরি করেনি মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়লেও বৈশ্বিক পণ্য প্রবাহে কোনও নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। মহামারির ধাক্কা থেকে বেরিয়ে এসেছে বিশ্ব বাণিজ্য; চলতি বছর এটা আরও শক্তিশালী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এর বাইরে গিয়ে একটু গভীরভাবে তাকালে বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বলতা চোখে পড়বে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব অর্থনীতিকে শাসন করে আসছে যে ব্যবস্থা, বহু বছর ধরে ভেতর থেকে সেটির অবক্ষয় ঘটছে; যা আমাদের চোখে পড়েনি। কিন্তু এখন এসে এতোটাই নাজুক হয়ে পড়েছে যে, যেকোনও সময় হুড়মুড় করে ধসে পড়তে পারে।
বর্তমানে বেশ কিছু উদ্বেগজনক পরিস্থিতি রয়েছে, যা এমন অধঃপতন নিয়ে আসতে পারে, যাতে বিশ্বজুড়ে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে- যেখানে পেশিশক্তি ন্যায়-অন্যায়ের নির্ধারক হয়ে দাঁড়াবে এবং যুদ্ধই হবে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু।
এমনকি যদি কোনও যুদ্ধ না-ও হয়, তবুও অর্থনৈতিক রীতিনীতি খসে পড়ার পরিণত হবে নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ। খুব দ্রুতই এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে। পুরনো বিশ্ব-ব্যবস্থা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঘটনা এখন সর্বত্র দৃশ্যমান।
বিরোধী দেশগুলোর অর্থনীতি চেপে ধরতে ১৯৯০ এর দশকে যতটা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল, এখন তা চারগুণ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাশিয়ার সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সম্প্রতি আনুষঙ্গিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রাথমিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, এমন দেশ কিংবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করা সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে আনুষঙ্গিক নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।
এ সবকিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভর্তুকি যুদ্ধ। পরিবেশবান্ধব উৎপাদনে ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা দিচ্ছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। অন্য দেশগুলোও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। বিভিন্ন দেশ এই ভর্তুকি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। যদিও বিশ্ববাজারে এখনও ডলারের আধিপত্য, উদীয়মান অর্থনীতিগুলোও অনেক বেশি স্থিতিশীল কিন্তু বৈশ্বিক পুঁজি প্রবাহ ধীরে ধীরে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
পুরনো বিশ্ব-ব্যবস্থার রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করা সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে হয় অকার্যকর হয়ে পড়েছে কিংবা দ্রুত বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে।
আগামী বছর তিন দশকে পা রাখবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। কিন্তু আমেরিকার অবহেলার কারণে অন্তত আরও বছর পাঁচেক এটি অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকবে। আর পরিচয় সংকটে পড়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। পরিবেশবান্ধব কর্মসূচি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার কাজের মধ্যে আটকে আছে দাতা সংস্থাটি।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পুরোপুরি অচল। বৈরী দেশগুলোর বিরুদ্ধে ক্রমাগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
গাজা উপত্যকায় জেনোসাইডের জন্য ইসরাইলের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার হুমকি দিয়েছেন সিনেটে রিপাবলিকান দলের নেতা মিচ ম্যাককনেলসহ মার্কিন রাজনীতিবিদরা। এর আগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে জেনোসাইডের অভিযোগ দায়ের করে দক্ষিণ আফ্রিকা।
এই অবক্ষয়ের জন্য বিশ্ব অর্থনীতিকে খেসারত দিতে হচ্ছে। এটা চোখের আড়ালে ঘটছে, একেবারে গভীর থেকে। তবে এগুলোও সহজেই চোখে পড়বে যদি আপনি জানেন, কোথায় তাকাতে হবে। ইতিহাস বলছে, বিশ্ব অর্থনীতির নৈরাজ্যজনক ও গভীর পতন দ্রুতই ঘটতে পারে। যখন অধঃপতন শুরু হবে, আকস্মিকভাবে অর্থনীতি এক গভীর খাদে ধসে পড়বে।
বিশ্বায়নের এক স্বর্ণযুগকে ধ্বংস করে দিয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। যদিও অনেকেই তখন ভেবে নিয়েছিলেন, চিরকাল থাকবে সেই বিশ্ব-ব্যবস্থা। ১৯৩০ এর দশকের শুরুর দিকে, অর্থনৈতিক মন্দা ও স্মুট-হাউলি কর ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর মাত্র দুই বছরের মধ্যে আমেরিকার আমদানি চল্লিশ শতাংশ কমে যায়। মার্কিন বাণিজ্য নীতি সুরক্ষায় স্মুট-হাউলি নীতি করা হয়েছিল।
১৯৭১ সালের আগস্টে অপ্রত্যাশিতভাবে ডলারের স্বর্ণে রূপান্তরযোগ্যতা বাতিল করে দেন তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। এ ঘটনার এক বছর ৯ মাস পরে ব্রেটন উডসের নির্ধারিত বিনিময় হার ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে যায়।
বর্তমান সময়ে এসে সেই দুর্বলতার কথাই বিশ্বকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন তার নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপে বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয় ত্বরান্বিত হয় এবং নিয়মনীতি খেই হারাতে শুরু করে। বিশ্বকে তিনি ‘জিরো-সাম’ নীতিতে দেখতেন। যার অর্থ হচ্ছে- একপক্ষকে অবশ্যই বিজয়ী এবং অন্যপক্ষকে পরাজিত হতে হবে।
এছাড়া সস্তা চীনা পণ্যের দ্বিতীয় ঢেউয়ের শঙ্কা এই অধঃপতনকে ত্বরান্বিত করতে পারে। চীনা পণ্যের বাজার দখলের ভয় কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের মধ্যে। তাইওয়ান ঘিরে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে পুরদস্তুর যুদ্ধ কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের লড়াই এক সর্বাত্মক পতন নিয়ে আসতে পারে।
এই পতনের কম্পন এতটাই গভীর ও শক্তিশালী হতে পারে, যা মানুষ কখনো কল্পনাও করতে পারেনি। বৈষম্য, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট ও জলবায়ু পরিবর্তনকে অবহেলা করার কারণে নিয়ন্ত্রণহীন বিশ্বায়নকে সমালোচনা করা যায়। কিন্তু ১৯৯০ এর দশক থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত এই বিশ্বায়নের যে অভূতপূর্ব অর্জন তা ইতিহাসের পাতায় অতুলনীয় হয়ে থাকবে। এ সময়কে উদারনৈতিক পুঁজিবাদের সুবর্ণযুগ বলা হয়।
চলমান ব্যবস্থার এই অবক্ষয় অগ্রগতিকে মন্থর করে দেবে কিংবা আগে যে অবস্থায় ছিল সেটার বিপরীতে নিয়ে যাবে। আর এটি একবার ভেঙে পড়লে সেখানে নতুন কোনও ব্যবস্থা স্থলাভিষিক্ত করা অসম্ভব হয়ে উঠবে। এতে এমন নৈরাজ্য শুরু হয়ে যাবে, যাতে দস্যুতা ও সহিংসতার স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠবে বিশ্ব। কাজেই আস্থা ও সহযোগিতার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ছাড়া একুশ শতকের এসব প্রতিকূলতার মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ ক্ষেত্রে বিশ্বকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অস্ত্র প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণ এবং মহাকাশে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। কিন্তু ইউরোপের কার্বন বর্ডার ট্যারিফ কিংবা আইএমএফের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব ক্ষোভ তৈরি করতে পারে। বিদেশ থেকে ইস্পাত, সিমেন্ট ও অন্যান্য পণ্য আমদানিতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমনের শুল্ক আরোপ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দূষণের জন্য দায়ী পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মতো অন্যদের চোখে উদারনৈতিক ব্যবস্থা কোনও উঁচু আদর্শভিত্তিক বিধি না, এটা কেবল মার্কিন অবাধ ক্ষমতার চর্চার ক্ষেত্র; যা ধীরে ধীরে ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে।
প্রথমে ধীরে, তারপর আকস্মিক পতন
এটা চরম সত্য যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে ব্যবস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেটি আমেরিকার আন্তর্জাতিকবাদী নীতিমালা এবং কৌশলগত স্বার্থের মেলবন্ধন। বিশ্বের অন্য দেশগুলোর জন্যও এই ব্যবস্থা অনেক সুবিধা ও সুযোগ এনে দিয়েছে। করোনা মহামারির পর বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশ আইএমএফের সভরেন-ডেট (সরকারি ঋণ) সংকটে ভুগছে। এসব দেশ নিজেদের ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না।
আবার পুরনো বিশ্ব-ব্যবস্থার ভেঙে পড়ার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো মধ্যম আয়ের দেশগুলো। কিন্তু বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গেই একীভূত থাকতে হচ্ছে তাদের। ব্রিটেন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো উন্নত এবং মুক্ত অর্থনীতির দেশগুলোকে তাদের সমৃদ্ধির জন্য বাণিজ্যের ওপরই নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। সবমিলিয়ে আমেরিকার জোরালো প্রবৃদ্ধি দেখে মনে হতে পারে, যাই হোক না কেন, বিশ্ব অর্থনীতি টিকে যাবে কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না!