দীর্ঘ সময় ধরে চরম অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে পাকিস্তান। রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রাতিষ্ঠানিক অনিয়ম ও দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, করোনা মহামারি, বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশটির অর্থনীতিকে নাজুক করে তুলেছে।
সংকট মোকাবিলায় বিদেশি সাহায্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণও নিতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বিকল্প চিন্তা-ভাবনা করছে পাক কর্তৃপক্ষ। পরিকল্পনা করা হচ্ছে গাঁজা চাষের। প্রশ্ন হলো গাঁজা কি পাকিস্তানের মন্থর অর্থনীতির চাকা ঘুরাতে পারবে?
গাঁজা সাধারণত মাদক হিসেবেই বেশি পরিচিত। তবে এর কিছু ভেষজ গুণ রয়েছে এবং ওষুধ হিসেবেও এর প্রয়োগ হয়। মাদক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় অনেক দেশেই এটি নিষিদ্ধ। আবার ওষুধি ব্যবহারের জন্য অনেক দেশই এর ব্যবহার বৈধ করেছে। এমনকি বহুদিন নিষিদ্ধ থাকলেও সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও গাঁজা দিয়ে ওষুধ তৈরির অনুমতি দিয়েছে।
দিনদিন এর চাহিদা বাড়ায় আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এর একটা বড় বাজার তৈরি হয়েছে। যে বাজার প্রতিবছরই বিস্তৃত হচ্ছে। অর্থনীতি চাঙ্গা করতে বিকাশমান সেই বাজারের সুযোগ নিতে চাচ্ছে পাকিস্তান। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে গাঁজা চাষ বিষয়ক একটি অধ্যাদেশও জারি করা করেছে।
যে অধ্যাদেশ বলে কানাবিস কনট্রোল অ্যান্ড রেগুলেটরি অথোরিটি (সিসিআরএ) নামে একটি নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কাজ ‘চিকিৎসা ও শিল্প খাতে ব্যবহারের জন্য গাঁজার চাষ, আহরণ, পরিশোধন, উৎপাদন ও বিক্রয় নিয়ন্ত্রণ করা’।
নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান তৈরির বিষয়টি প্রথম প্রস্তাব করা হয়েছিল ২০২০ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আমলে। তবে অভ্যন্তরীণ জটিলতায় এর গঠনের উদ্যোগ থেমে যায়। চার বছর পর নতুন করে একে কার্যকর করার বিষয়টি গাঁজা চাষে পাকিস্তানের মরিয়ে চেষ্টার দিকটি ইঙ্গিত করছে। যা দেশটির সরকারের এক সিনিয়র কর্মকর্তার কথাতেই পরিষ্কার।
বিনিয়োগ বিষয়ক বিভাগের ওই কর্মকর্তা বলেন, গাঁজা চাষের উদ্যোগ নিয়ে আমরা খুবই সচেষ্ট। খুব দ্রুত গতিতে সব কিছু এগিয়ে যাচ্ছে। নতুন জোট সরকার নীতি, উৎপাদনকারী ও বিক্রেতাদের লাইসেন্স প্রদান ও চাষের অঞ্চল নির্দিষ্ট করতে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠন করেছেG
আয়ারল্যান্ডভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটস-এর মতে, ২০২২ সালে গাঁজার বৈশ্বিক বাজার ছিল ৭ বিলিয়ন তথা ৭০০ কোটি ডলারের। ২০২৭ সাল তথা আগামী তিন বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৩০ বিলিয়ন তথা ৩ হাজার কোটি ডলারে। ব্যাপকভাবে গাঁজা চাষের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান এই বাজার ধরতে চাইছে পাকিস্তান।
বেশিরভাগ দেশের মতো পাকিস্তানেও গাঁজা চাষ নিষিদ্ধ। ১৯৮০-এর দশকে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউল হক গাঁজা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ওই সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের মাদকের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ চলছিল।
নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ গঠনের ফলে চিকিৎসা ও শিল্পখাতে গাঁজার চাষ ও ব্যবহার অনুমোদন করা হবে। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রীয় গবেষণা সংস্থা পাকিস্তান কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (পিসিএসআইআর) এবং সিসিআরএ-র গভর্নর বোর্ডের সদস্য সৈয়দ হুসেন আবিদি বলেন, জাতিসংঘ আইনের অধীনে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠা গঠন প্রয়োজন ছিল।
আল জাজিরাকে এক সাক্ষাৎকারে এই গবেষক আরও বলেন, জাতিসংঘের আইন বলে যে যদি কোনো দেশ গাঁজা-সম্পর্কিত পণ্য উত্পাদন, প্রক্রিয়াকরণ ও বিক্রয় করতে চায়, তবে সেই দেশটির একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে যা সরবরাহ চেইন ঠিক করবে এবং আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধবতা নিশ্চিত করবে।
আবিদি বলেন, পাকিস্তান তার নিজের সুবিধার জন্য ভেষজ গাছটির চাষকে কাজে লাগাতে চায় এবং রফতানি, বিদেশি বিনিয়োগ এবং অভ্যন্তরীণ বিক্রয়ের মাধ্যমে রাজস্ব আয় ও বৈদেশিক রিজার্ভ বাড়াতে চায়।
পাকিস্তানি আইনে গাঁজার চাষ নিষিদ্ধ হলেও দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে হাজার হাজার হেক্টর জমি রয়েছে যেখানে শত শত বছর ধরে গাছটির চাষ হচ্ছে। কিন্তু এর ওপর সরকারের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু গত ফেব্রুয়ারি মাসে যে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে তাতে বিষয়টিতে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
অধ্যাদেশে একদিকে গাঁজা চাষে ব্যাপক নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে বৈধভাবে গাঁজার উৎপাদনে কৃষকদের লাইসেন্স দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। লাইসেন্স ছাড়া চাষ করলে শাস্তির বিধানও করতে পারে সরকার। আবিদি বলেন, অধ্যাদেশটি পাস হওয়ার পর থেকে গাঁজার চাষ এখন কার্যত বৈধ। কিন্তু আমরা এখনও (নিয়ম ও পদ্ধতি তৈরির) প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছি এবং কর্তৃপক্ষের নিবন্ধনের অপেক্ষায় আছি।
গাঁজা চাষের জন্য একজন কৃষককে পাঁচ বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া হবে। এর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এমন এলাকা নির্ধারণ করবে যেখানে বৈধভাবে গাঁজা চাষ করা যায়। আবিদি বলেন, প্রাথমিক হিসেব অনুসারে প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে যেখানে গাঁজা চাষ করা হয়। যার বেশিরভাগ খাইবার পাখতুনখোয়া ও দক্ষিণ-পশ্চিম প্রদেশ বেলুচিস্তানে।
আবিদি আরও বলেন, গাঁজা চাষে আমাদের দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। আমাদের এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। পাকিস্তানি এই কর্মকর্তার মতে, নিয়ন্ত্রক কাঠামো নিশ্চিত করবে যে মানুষ যেনও কেবল নির্ধারিত চিকিৎসায় ব্যবহৃত পণ্য পায়। এটি গাঁজার অবৈধ বিক্রয় ও সেবন দমন করবে। পরিচ্ছন্ন পণ্য খুচরা বিক্রির জন্য পাওয়া গেলে তা কালোবাজারি কমাতে সহযোগিতা করবে এবং শুধু চিকিৎসাপত্র দিয়ে রোগীরা এমন ওষুধ পাবেন।