আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে থেকে বড় হয়েছেন সাফজয়ী নারী ফুটবলার আরিফা আক্তার। অভাবের সংসারে দুবেলা খেয়ে-পরে বাঁচা দায় হয় তাদের। সম্পদ বলতে শতাধিক পদকই শেষ সম্বল। তিন বোন আর মা থাকলেও এক টুকরো সোনার গহনাও পড়া হয়নি তাদের। আলমারি ভরতি কেবল জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক টুর্নামেন্টের পদকে ভরা। এই পদকই আরিফার মায়ের কাছে এখন সোনার গহনার চাইতে দামি।
আরিফা আক্তারের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর উপজেলার রুপসদী গ্রামে। সম্প্রতি ভারতকে হারিয়ে নারী অনূর্ধ্ধ-১৬ দলের চ্যাম্পিয়ন দলের খেলোয়াড় সে।
সরেজমিনে আরিফার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পের একটি ঘরে বসবাস তার বাবা-মাসহ পরিবারের। ঘরের ভেতরে নেই তেমন কিছুই। একটি আলমারির ভেতর থরে-বিথরে সাঁজানো শুধু শতাধিক পদক।
কথা হয় তার মা আলেয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমার মেয়ে আরিফারে বহুত কষ্টের পর এই জায়গায় আনছি। খাওন (খাবার) ও জুটতো না অনেক সময়। তবে মেয়ের প্রতিভারে খাটো (ছোট) কইরা দেখি নাই। খেলাধুলার প্রতি তার আগ্রহ দেইখা ভাবছিলাম যতো কষ্টই হোক মেয়েরে শেষ পর্যন্ত নিমু। আইজাকা আমার মাইয়া বিশ্ব জয় করছে, দেশরে সবার সামনে তুইলা ধরছে এর চাইতে বড় কিছু আর কি হইতে পারে ‘
তিনি আরও বলেন, ‘সংসারে আয় রোজগার খুবই কম। আমার মাইয়া যে পদক আনছে ঐ গুলার দিকেই দিন রাইত চাইয়া থাকি। অনেক ধনী মাইনষের ঘরেও তো এতো পদক নাই, এই গুলা আমার মাইয়ার (মেয়ের) অর্জন, সোনা-দানা না থাকলেও আমার আফসোস নাই, এগুলাই আমার আর আমার মাইয়ার গহনা।’
বাড়িতে হঠাৎ একটি অটোরিকশা নিয়ে আসেন এক লোক। জানা যায় তিনিই আরিফার বাবা জিতু মিয়া। সংসারের একমাত্র রোজগারের মানুষ।
সামনে এগিয়ে যেতেই হাসিমুখে বলে ওঠেন, আমার মাইয়ার জন্য বাইত সাংবাদিক আইছে, কি সৌভাগ্য আমার। কথা প্রসঙ্গে ওঠে মেয়ের ফুটবল খেলার শুরুটা নিয়ে।
তিনি বলেন, ‘প্রথমে তো অনেক অনেক কথা কইতো, মাইয়ারে কেন ফুটবল খেলায় দিলাম, এসব বালা না। নানান কথা শুনাইছে মানুষ, কিন্তু গায়ে মাখি নাই। আমার অটোরিকশা দিয়াই ওরে কোচিংয়ে আনা নেওয়া করছি, খুব আনন্দ লাগতো।’
মেয়ের এমন অর্জন সম্পর্কে বাবা জিতু মিয়া বলেন, ‘আমার মাইয়ারে এহন টিভিতে দেহা যায়, দেশের সুনাম আনছে সে। এহন সবাই আমারে বাহবা দেয়। এলাকার মানুষ আমারে সম্মান দেয় মাইয়ার জন্য, প্রশাসনের লোকেরা আমারে আলাদা নজরে দেখে। দিন বদলাইছে অনেক, সবার পোলা-মাইয়ারেই আগ্রহ অনুযায়ী দেয়া উচিত যেই দিকে যাইতে চায়।’
আরিফার কোচ মীর রফিকুল ইসলাম বলেন, ছোট থেকেই আরিফা আমাদের নজর কাড়ে। আমাদের ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম ফুটবল ক্লাবে তারে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি। এখান থেকেই তার বেড়ে উঠা। আমি তাকে আমার মেয়ের মতোই দেখি। প্রাথমিক পর্যায় থেকেই সে উপজেলা, জেলা, বিভাগে বেশ ভালো খেলতে শুরু করে। শিরোপা এনে দেয় আমাদের, নিজের শ্রেষ্ঠত্বে সাফে ডাক পায়, আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি আরিফার।
আরিফার প্রতিবেশি আবু নাইম বলেন, আরিফার জন্য আমরাও গর্বিত। আমাদের এলাকার মেয়ে দেশের সুনাম বয়ে আনছে। যেই পরিশ্রম করেছে এই পরিবারটি তার ফল পাচ্ছে এখন। আরিফার বাবা-মা স্বার্থক। প্রশাসন যদি তাদের পরিবারের দিকে আরো একটু দেয়, সহযোগিতা করে তাহলে আরও ভালো করবে আরিফা।
সবশেষ কথা হয় আরিফার সঙ্গে। সদ্য সাফজয়ী এই ফুটবলার হাসিমুখে বলেন, আমার পরিবার এবং স্থানীয় সংসদ সদস্য ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলাম আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছেন, যার কারণেই এতদূর আসতে পেরেছি। খেলাধুলার দিকে অনেক সময় দিয়েছি, অনেক পরিশ্রম করেছি, জানিনা কতটুকু পেরেছি তবে চেষ্টা করছি।