প্রকৃত রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কম। কিন্তু আমলা, ব্যবসায়ী জনপ্রতিনিধি হলে তাদের জনগণের ওপর দায়বদ্ধতা থাকে না। তাই তারা সহজেই দুর্নীতে জড়িয়ে পড়েন। জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই এদেশের রাজনীতিতে আমলাতন্ত্রের প্রসার ঘটে। সেই ধারা এখনও অব্যাহত আছে বলে মনে করেন বগুড়া -৫ (শেরপুর-ধুনট) এর সংসদ সদস্য ও বগুড়া জেলা আ লীগের সভাপতি মজিবর রহমান মজনু। এছাড়া তিনি শেরপুর ধুনটের উন্নয়ন অগ্রগতি নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদর্পণের সাথে।
বাংলাদর্পণ: আপনি ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সাথে যুক্ত। কয়েক বছর ধরে বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এবারে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। রাজনীতিতে আসার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।
মজনু: আমি ১৯৫২ সালে বগুড়ার শেরপুর পৌর শহরের উলিপুর পাড়ায় জন্ম গ্রহণ করি। শেরপুরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে বগুড়ার সেন্ট্রাল হাই স্কুলে ৬ শ্রেণিতে ভর্তি হই। সেখানে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ নিয়মিত আসতেন। তারা পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এরপর ১৯৬৭ সালে এসএসসি পাশ করে বগুড়ার আযিযুল হক কলেজে ভর্তি হয়ে সক্রিয় ছাত্র রাজনীতি শুরু করি। তখনও শেরপুরে ছাত্র লীগের কোন কমিটি ছিলো না। এরপর সংগঠনের নির্দেশে আযিযুল হক কলেজ ছেড়ে শেরপুর ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র লীগ গঠন করি। এরপরে কলেজ ছাত্র লীগের সভাপতি, ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র লীগের শেরপুর থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, মুক্তিযুদ্ধের সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়কের দায়িত্ব পালন করি। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৭ সালে আমাকে শেরপুর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এভাবেই আমার সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের শুরু হয়।
বাংলাদর্পণ: আপনি তো ৬০ এর দশক থেকে রাজনীতির সাথে যুক্ত। এই ৬ দশকে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে বলে আপনি মনেকরেন?
মজনু: তখন রাজনীতিতে যে সংহিসতা ছিলো না তা বলা যাবে না। তবে এখনকার মতো আগ্নেয়স্ত্র ব্যবহার হতো না। চাকু হকিস্টিকের মতো সাধারণ অস্ত্র ব্যবহার হতো। প্রধানত তৎকালীন সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন এনএসএফ এসব ব্যবহার করতো। এখন রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা কমে যাওয়ায় সহিংসতা বেড়ে গেছে। বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এ দেশের ছাত্র সমাজ অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু ৭৫ পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে জিয়াউর রহমান অভি ও নীরুর মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিতে সন্ত্রাসের অনুপ্রবেশ ঘটান। সেই ধারাবাহিকতা এখনও চলছে।
বাংলাদর্পণ: আমরা লক্ষ করেছি দলীয় নমিনেশনের ক্ষেত্রে বার বার অরাজনৈতিক ব্যাক্তিগণ প্রাধান্য পেয়েছেন। আপনি কি মনেকরেন রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরিন আমলাতান্ত্রিক প্রবনতার ফল?
মজনু: আসলে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন। আগে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এই প্রবনতা ছিলো না। যারা প্রকৃতই রাজনীতিবীদের দুর্নীতির সাথে যুক্ত হওয়ার সুযোগ কম। কারণ জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকে। কিন্তু ব্যবসায়ী বা আমলা প্রশাসন থেকে আসা ব্যক্তিদের সেটা থাকে না। তাই প্রকৃত রাজনীতিবীদের মূল্যায়ন ছিলো। এখন সেটা কমে গেছে। নতুন দল গঠন করার সময় জিয়াউর রহমান শিল্পপতি আমলাদের প্রাধান্য দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সেই ধারা এখনও অব্যহত আছে। আমাদের এখান থেকে বেড়িয়ে আসা উচিৎ।
বাংলাদর্পণ: আপনি দীর্ঘদিন স্থানীয় সরকার অর্থাৎ পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। এখন আপনি একজন এমপি অর্থাৎ আইনপ্রনেতা নির্বাচিত হয়েছেন। আমরা লক্ষ করেছি সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ি প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা সবকিছু পরিচালিত হবে। কিন্তু উপজেলা পরিষদ আইনের মাধ্যমে একজন নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে সকল ক্ষমতা ন্যাস্ত করা হয়েছে। এটাকে আপনি কিভাবে দেখেন?
মজনু: একথা অনস্বীকার্য যে প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। তাই প্রশসনকে বিকেন্দ্রীয় করণের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু জেলা গভর্ণর ও উপজেলা প্রশাসনের প্রচলন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর এরাশাদ সরকার উপজেলা চালু করে। তখনও আওয়ামী লীগ তার বিরোধিতা করেনি। এরপর বিএনপি সরকার গঠন করলে এমপি ও আমলারা উপজেলা পরিষদের বিরোধিতা করেন। ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার একবছরের মাথায় উপজেলা পরিষদ বাতিল করা হয়। তবে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কিন্তু তা আবার চালু করা হয়। এখন জগণের প্রতিনিধি দ্বারা পরিচালিত হলেও কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আছে। আমাদের দল স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার জন্য চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে জাতীয় সংসদে আলোচনা হলে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে আনার পক্ষে আমার সক্রিয় ভূমিকা থাকবে।
বাংলাদর্পণ: অতীতে শেরপুর-ধুনটের রাজনীতিতে সহ অবস্থান থাকলেও বর্তমানে তার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে আপনি কি ধরণের ভূমিকা রাখবেন?
মজনু: এটা শুধু আমার নির্বচনী এলাকায় না, সারা দেশেই বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে এসব থাকে। তাবে এখনে আমি সেই অর্থে গ্রুপিং বলতে নারাজ। আপনি জানেন আমি ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি করে এখন এই পর্যায়ে এসেছি। এর আগে ২০০১ সালে আমি দলীয় মনোনয়ন পেলেও একজন বিদ্রোহী প্রার্থীর কারেণ সংসদ নির্বাচনে হেরেছি। কিন্তু কারও সাথে আমার কোন বৈরীতা ছিলো না। কিন্তু ২০০৮ সাল থেকে পর পর যিনি দলীয় মনোনয়নে নির্বচিত হয়েছিলেন তার মধ্য রাজনৈতিক সদাচারের অভাব ছিলো। তাই সুবিধাবাদী কিছু চক্র তার সাথে থেকে ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমি ধৈর্য্যের সাথে সেসব মোকাবেলা করে দলীয় শৃঙ্খলা অটুট রেখেছি। এখন আমি নির্বাচিত হওয়ার পরে এখানে আর কোন গ্রুপিং নেই। আমি সবাইকে নিয়ে এলাকার উন্নয়ন করতে চাই।
বাংলাদর্পণ: মহাসড়কের শেরপুর শহরের অংশে ফ্লাইওভার না থাকায় বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। এটা নিরসনে আপনার ভূমিকা কেমন হবে?
মজনু: এটা ঠিক শেরপুরে ফ্লাইওভার না থকলে শহর দুইভাগে বিভক্ত হবে। শুরুতে পরিকল্পনায় থাকলেও পরে বিশ্ব ব্যাংক কেন এটা বাদ দিয়েছে তা আমার বোধগম্য নয়। এবিষয়ে আমি সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও সড়ক ও সেতু মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদেরের সাথে কথা বলেছি। অচিরেই সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে শেরপুর শহরে ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হবে।
বাংলাদর্পণ: শেরপুর ধুনটের সার্বিক উন্নয়নে আপনার পরিকল্পনার কথা বলুন।
মজনু: বিগত ১৫ বছরে সারা দেশের মতো শেরপুর ধুনটেও মানুষের জীবন মানের সাথে সাথে রাস্তা-ঘাট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোর অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আগামী দিনে বাংগালী নদীর উপর ঝাঁঝর ও সুঘাটে ব্রীজ নির্মান করা, শেরপুরে গ্যাসের সংযোগ করতে চাই।
বাংলাদর্পণ: এলাকার শিশু কিশোরদের মানসিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?
মজনু: শিশু কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট চালু করেছে। এছাড়াও সরকারিভাবে মিনিস্টেডিয়াম তৈরি করার নির্দেশন আছে। আমি সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। শেরপুরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের ঐতিহ্য বেশ পুরনো। কিন্তু সঠিকভাবে পরিচর্যার অভাবে কিছুটা ভাটা পড়েছে। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে সীমিত ক্ষমতার মধ্যে চেষ্টা করেছি। এখনও চেষ্টা অব্যহত থাকবে।
বাংলাদর্পণ: সর্বপরি আপনার এলকা জনগণের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।
মজনু: এলাকার জনগণ আমাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন। এজন্য আমি তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এলাকার সার্বিক উন্নয়ন করে জনগনের আস্থার মর্যাদা রাখতে চাই।
বাংলাদর্পণ: আপনাকে ধন্যবাদ।
মজনু: আপনাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ।