এক সময় যেসব জমিতে ধান, ভুট্টা ও গমের মতো বিভিন্ন ফসল চাষ হতো সেসব জায়গায় এখন চাষ হচ্ছে পপি যা থেকে তৈরি হয় আফিম।
সেনা অভ্যুত্থানের পর গত তিন বছর ধরে চলমান সংঘাতের সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটে খাদ্যশস্য চাষ ছেড়ে ভয়ঙ্কর এই মাদক চাষে নেমেছেন দেশটির কৃষকরা। এএফপি’র এক প্রতিবেদনে এ খবর উঠে এসেছে।
আফিম উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশ মিয়ানমার
এশিয়ায় এখন সবচেয়ে বেশি আফিম উৎপাদনকারী শীর্ষ দেশ মিয়ানমার। এর আগে বহু বছর ধরে এই শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছিল আফগানিস্তান। তবে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর দেশটিতে আফিম চাষ ব্যাপকভাবে কমে গেছে।
২০০১ সালে তালেবান সরকারকে উৎখাত করে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসার পর আফগানিস্তানে আফিমের উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রায় দুই দশকের সশস্ত্র লড়াইয়ের পর ২০২১ সালের আগস্টে ফের দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয় তালেবান।
পরের বছর তথা ২০২২ সালে আফগানিস্তানের মাদকদ্রব্য ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তালেবান সরকার। এরপর দেশটিতে আফিম চাষ ৯৫ শতাংশ কমে যায়। আফিম উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষস্থান দখল করে মিয়ানমার।
২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার উৎখাতের পর থেকে দেশটিতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। যার ফলে অনেকেই আফিম চাষের দিকে ঝুঁকেছেন বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সংক্রান্ত কার্যালয় (ইউএনওডিসি)।
আফিম চাষে লাভ বেশি
গত বছরের শেষ দিকে প্রকাশিত জাতিসংঘের ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম অধিদফতরের (ইউএনওডিসি) এক প্রতিবেদন মতে, মিয়ানমারের কৃষকরা আফিম চাষ করে ৭৫ শতাংশের বেশি আয় করেন।
প্রতি কেজি আফিম থেকে গড়ে ৩৫৫ ডলার বা ৩৯ হাজার টাকা আয় হয় এবং চাষের জমি গত বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ বেড়ে ৪৭ হাজার হেক্টরে পৌঁছেছে।
যার ফলে, ২০০১ সালের পর দেশটিতে সর্বোচ্চ আফিম উৎপাদনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। ইউএনওডিসির আঞ্চলিক প্রতিনিধি জেরেমি ডগলাস জানান, ২০২১ এর ফেব্রুয়ারিতে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর অর্থনীতি, সুরক্ষা ও সুশাসনে প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়। যার ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাষীরা জীবিকা অর্জনের জন্য আফিম চাষের দিকে ঝুঁকছেন।
মিয়ানমারে উত্তরের সীমান্তবর্তী শান, কিন ও কাচিন রাজ্যে আফিম চাষ সবচেয়ে বড় আকারে সম্প্রসারিত হয়েছে। ইউএনওডিসির প্রতিবেদন মতে, সূক্ষ্ম চাষাবাদের কারণে প্রতি হেক্টরে আফিমের উৎপাদন ১৬ শতাংশ বেড়ে ২২ দশমিক ৯ কেজি হয়েছে।
ডগলাসের মতে, আগামীতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও দেশটির ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘাত বাড়লে আফিম চাষ আরও দ্রুতগতিতে বাড়বে। আফিম চাষের পাশাপাশি মিয়ানমারে উচ্চমাত্রায় অন্যান্য সিনথেটিক মাদক উৎপাদন ও পাচারের অবৈধ কার্যক্রম দীর্ঘদিন ধরেই চলছে।
ধান ও ভুট্টার জমিতে আফিম
শান ও কারেন রাজ্যের সীমান্ত ঘেষে পাহাড়ঘেরা বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এক সময় ধান, গম ও ভুট্টাসহ বিভিন্ন ফসল ফলত। এখন শুধুই আফিম আর আফিম। এই এলাকায় কৃষক অং ময় উ’ও আফিম চাষ করেছেন। নিজের আফিমের ক্ষেতের আইল থেকে এএফপিকে ময় উ বলেন, সম্প্রতি আমি আফিম চাষের পরিকল্পনা করি। তবে প্রথমে অল্প পরিমাণ চাষ করি। এবার চাষ করেছি তিন একর।
এই তিন একর জমি থেকে ১৬ কেজির মতো আফিম উৎপাদনের আশা করছেন অং ময়। যা বিক্রি করে প্রায় সাড়ে চার হাজার ডলার (পাঁচ লাখ টাকার সমান) পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তিনি। বৈধতার প্রশ্ন কোনো মাথাব্যথা নেই তার। অং ময় বলেন, পপি চাষই আমাদের পরিবারের জন্য জীবিকা নির্বাহের সর্বোত্তম উপায়।
এই অঞ্চলের আরেক কৃষক অয় অয় থেইন। তিনিও আগে তার জমিতে ধান, ভুট্টা ও ডালজাতীয় ফসল ফলাতেন। সেই জায়গায় এখন চাষ করছেন পপি ফুল যা থেকে আফিম তৈরি হয়।
২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্রের পথের যাত্রা থমকে গেছে। এরপর থেকে চলছে নজিরবিহীন সংঘাত। গত বছরের অক্টোবর থেকে যা আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। সেনা সরকারের উৎখাতে লড়াই করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো।
জাতিসংঘের তথ্য মতে, প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে অয় অয় থেইনকেও ভিটেবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। সম্প্রতি আবারও নিজ এলাকায় ফেরেন তিনি।
অয় অয় জানান, বাড়ি ছাড়ার আগে ধান ও অন্যান্য ফসল চাষ করতেন তিনি। কিন্তু স্থানীয় কিয়াত মুদ্রার মান কমে যাওয়ায় সারের মতো কৃষি উপকরণ কেনা তার জন্য অনেক বেশি ব্যয়বহুল হয়ে পড়ে। অয় অয় বলেন,
রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের পর থেকে লড়াই চলছেই। ফলে আমরা আমাদের মাঠে কিছুই উৎপাদন করতে পারি না।
অয় অয়ের কথায় একমত হন অং মো উও। তিনি বলেন, আমরা যদি আমাদের ফসল দালালদের আড়তে পাঠাই, তাহলে অনেক খরচ হয়। যা আমাদের পক্ষে বহন করা কঠিন। আর তাই আমরা এ বছর ভুট্টার পরিবর্তে পপিল লাগিয়েছি।