Homeআন্তর্জাতিকসোমালীয় দস্যুদের দুর্ধর্ষ যতো জাহাজ লুট আর অপহরণ!

সোমালীয় দস্যুদের দুর্ধর্ষ যতো জাহাজ লুট আর অপহরণ!

জাহাজ লুট, নাবিকদের অপহরণ, অতর্কিত হামলা — এসব নানা অপরাধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। বছরের পর বছর ধরে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায়, প্রাণনাশের পাশাপাশি দুর্ধর্ষ সব কর্মকাণ্ডের মূল হোতা আফ্রিকার এ দেশটির দস্যুরা। আসুন দেখা যাক, এদের দুর্ধর্ষ যতো জাহাজ লুট আর অপহরণের ঘটনা!

১৯৯৫ সালে এদের বিচরণ শুরু হলেও সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এদের অপতৎপরতা বেড়েছে বহুগুণে। বেশিরভাগ সময় তারা মুক্তিপণের বিনিময়ে জাহাজ ও নাবিকদের ছেড়ে দিলেও, কয়েকটি ঘটনায় জিম্মিকে হত্যা করে দস্যুরা।

লোহিত সাগর ও আরব সাগরের নীল জলরাশির সমুদ্র ঘেঁষে অবস্থিত পৃথিবীর অন্যতম দস্যুরাষ্ট্র সোমালিয়া। হর্ন অব আফ্রিকার এ দেশের নামটুকু শোনামাত্র মানসপটে ভেসে ওঠে পণ্য পরিবাহী জাহাজ লুটপাট, নাবিকদের অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় কিংবা অতর্কিত হামলা, গোলাবর্ষণসহ দুর্ধর্ষ সব কর্মকাণ্ডের ভয়ংকর চিত্রপট।

১৯৯৫ সালের কোনো একদিন। উপকূলে অবৈধ জাহাজের অনুপ্রবেশ রোধে চলছে নজরদারি। নিত্যদিনের মতোই বসে কঠোর পাহাড়া। স্থানীয় জেলেদেরই কয়েকটি দল পালাক্রমে পালন করে এ দায়িত্ব। কিছুক্ষণ পর অদূরে একটি জাহাজ ভেসে থাকতে দেখে জেলেরা। ঝটপট জাহাজটিকে ঘিরে ফেলে তারা। জেলেদের কোটরাগত বিবর্ণ চোখ আর শুকনো চোয়ালের মুখাবয়ব দেখে ঘাবড়ে যায় নাবিকরা। পরে মূল্যবান অর্থসামগ্রীর বিনিময়ে প্রাণে বেচে যান তারা। সেদিনের সেই ছোট্ট ঘটনাই মোড় নেয় আধুনিক জলদস্যুতায়।

২০০৫ সালে এমভি ফাইস্টি নামে একটি পেট্রোলিয়াম গ্যাস ট্যাঙ্কার ছিনতাই করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। হংকং ভিত্তিক কোম্পানির জাহাজটির মালিক পরবর্তীতে তিন লাখ ১৫ হাজার ডলার দিয়ে মুক্ত করে তা। এমনটাই জানায় জাতিসংঘ। একই বছর এমভি স্যামলো নামে অন্য আরেকটি জাহাজ আটক করে জলদুস্যরা। জাহাজটি জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সুনামি দুর্গতদের জন্য খাবার নিয়ে মোম্বাসা, কেনিয়ার থেকে বোসাসো যাচ্ছিলো। এ ঘটনার ১০০ দিন পর মুক্তিপণ ছাড়াই জাহাজটি ছেড়ে দেয় দস্যুরা।

এখানেই শেষ নয় কয়লার কার্গো নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে তুরস্কের দিকে যাচ্ছিলো এমভি পানজিয়া নামের একটি জাহাজ। সোমালিয়া উপকূল থেকে ৯০ নটিক্যাল মাইল দস্যুদের কবলে পড়ে এটি। পরবর্তীতে কেনিয়ার মোম্বাসায় জলদস্যুদের প্রতিনিধির কাছ থেকে সাত লাখ ডলার মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজটি ছাড়িয়ে নেয় ইউক্রেন ভিত্তিক কোম্পানিটি।

এত এত ছিনতাইয়ের ভেতর রয়েছে কিছু ভিন্ন গল্পও। ২০০৫ সালে ২১০জন যাত্রী নিয়ে সমুদ্রপথে যাত্রা করে সীবর্ণ স্পিরিট নামে বিলাসবহুল একটি জাহাজ। দুটি স্পিডবোটে নিয়ে তাদের ওপর ক্রমাগত আক্রমণ ও গুলিবর্ষণ করে জলদস্যুরা। কিন্তু যাত্রীদের বিচক্ষণতায় ব্যর্থ হয় তারা।

কোন রকম ক্ষান্ত না দিয়ে ২০০৬ সালে আবারও দস্যুগিরির খেলায় মেতে ওঠে তারা। ভারতের নিবন্ধিত এমভি সাফিনা আল-বিরসারাত ও এর ১৬ জন ক্রুকে আটক করে তারা। পরে আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর তৎপরতায় আত্মসমর্পণ করে ১০ জলদস্যু এবং তাদের পাঠানো হয় কেনিয়ার মোম্বাসায়। যেখানে সাত বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন তারা। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের আরও কিছু জাহাজ ছিনতাই করতে গেলে ব্যর্থ হয় সোমালিয়ান জলদস্যুরা, প্রাণ হারান একজন এবং গ্রেফতার করা হয় আরও ১২ জনকে।

২০০৭ এর চিত্রটাও কিছুটা একইরকম। স্বংয়ক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে ছয় কেনীয় ও শ্রীলঙ্কানসহ মোট ১২ জনের একটি জাহাজ দখল করে তারা। এরপর ২৭ ফেব্রুয়ারি সোমালির কোস্টগার্ডের সদস্যরা জাহাজটি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালালে ব্যর্থ হন তারা। উল্টো প্রাণ হারান দুই কোস্টগার্ড। একই বছর মে মাসে ১০ জন চীনা, ২ তাইওয়ানী ও ২ ফিলিপিন্সের নাগরিকসহ একটি মাছ ধরার জাহাজ আটক করে জলদস্যুরা। এদের ভেতর এক চীনা নাগরিককে হত্যা করে তারা। কারণ মালিক পক্ষ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেখা করতে ব্যর্থ হয়। জলদস্যুদের এই ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পায়নি তানজানিয়া, ডেনমার্ক, গ্রিস, জাপান ও উত্তর কোরিয়াসহ অন্যান্য দেশের জাহাজ।

২০০৮ সালে সোমালিয়ার উপকূলবর্তী ভারত মহাসাগরে বাণিজ্যিক জাহাজের ওপর একের পর এক আক্রমণ চালায় জলদস্যুরা। এই সোমালি জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়ে ৪৭ দিন আটক ছিলেন একজন জাহাজের ক্যাপ্টেন। অবশেষে ছয় লাখ ৭৮ হাজার ডলারের বিনিময়ে মুক্তি পান ওই ক্যাপ্টেন ও তার জাহাজ। ২০০৯ ও ছিলো তাদের রমরমা ছিনতাইয়ের সময়।

২০১০ সালের ৮ মে আরব সাগরের গালফ অব এডেনে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে জার্মান অয়েল ট্যাংকার মারিডা মারগারিটা। জাহাজের ২২ ক্রুর দুজন ছিলেন বাংলাদেশি। তাদের একজন সে সময়ের প্রধান কর্মকর্তা জাফর ইকবাল, অন্যজন দ্বিতীয় প্রকৌশলী গিয়াস উদ্দিন আজম খান। প্রায় সাড়ে সাত মাস জিম্মি থাকার পর ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর সাড়ে ৩৮ কোটি টাকার বিনিময়ে তারা মুক্তি পান।

এরপর ২০১৩ সালে জাতিসংঘ, ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশকিছু দেশের কঠোর হস্তক্ষেপ ও দমন নীতির পর সোমালীয়দের দস্যুবৃত্তি কমে আসে অনেকটা। তবে, ২০১৭ সালের মার্চ মাসে জ্বালানিবাহী ট্যাংকার এরিস আক্রমণের মাধ্যমে পাঁচ বছর পর আবারও বড়সড়ো কোনো হামলা করে তারা। চলতি বছর জানুয়ারিতে ইরানের পতাকাবাহী একটি মাছ ধরার জাহাজ অপহরণ করে সোমালিয়ার দস্যুরা। সেখানে ১৭ জন ইরানি নাগরিক ছিলেন।

একই মাসে ইরানের পতাকাবাহী আরেকটি মাছ ধরার জাহাজ এফভি আল নাঈমিতে ১১ জন সশস্ত্র জলদস্যু আক্রমণ করে ১৯ জন ক্রু সদস্যকে জিম্মি করে। তারা সবাই পাকিস্তানের নাগরিক। পরবর্তীতে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ আইএনএস সুমিত্র উদ্ধার করে জিম্মিদের।

সর্বশেষ খবর