Homeসর্বশেষ সংবাদদু’মাসে শতাধিক মা কাছিমের মৃত্যু, কারণ অনুসন্ধানে সাগরে যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা

দু’মাসে শতাধিক মা কাছিমের মৃত্যু, কারণ অনুসন্ধানে সাগরে যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা

কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে একের পর এক ভেসে আসছে মৃত মা কাছিম। মাত্র দু’সপ্তাহে মারা গেছে ৯২টি। এ নিয়ে চলতি বছরে ১০৩টি মৃত কাছিম ভেসে আসে। এসব মৃত মা কাছিম থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে ৯ হাজার ১৬০টি ডিম। জেলেদের দাবি, মা কাছিম মৃত্যুর পেছনে সাগরের ট্রলিং জাহাজই দায়ী। উদ্বেগজনক এ পরিস্থিতিতে এতো কাছিম মারা যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে সাগরে যাচ্ছে বিজ্ঞানীরা- এমনটা জানিয়েছে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ।

কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে একের পর এক ভেসে আসছে মৃত মা কাছিম। প্রতিটি কাছিমই অলিভ রিডলি প্রজাপতির। এসব কাছিমের সব কয়টির পেটে ডিম ছিল। আর কাছিমের সামনে ও পিছনের ফ্লিপারগুলো মারাত্মকভবে ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। বিশেষ করে কাছিমের গায়ে আঘাতের চিহ্ন এবং কিছু কিছু মৃত কাছিমের শরীরে জেলেদের জাল ও রশি প্যাঁচানো অবস্থায় পাওয়া গেছে।

কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল দিয়ে প্রতিদিনই সাগরে মাছ শিকারে যায় শত শত ট্রলার। এসব ট্রলারের জেলেদের দাবি, তাদের জালে কাছিম আটকা পড়লে তা তারা ধরে ছেড়ে দেন। মূলত সাগরে ট্রলিং জাহাজেই মারা পড়ছে সামুদ্রিক কাছিমগুলো।

ইনানী উপকূলের ডিঙি নৌকার জেলে আবদুল আউয়াল বলেন, ‘আমরা তো সাগরে মাছ শিকারে গেলে কাছিম দেখতে পাই। অনেক সময় আমাদের জালে আটকা পড়লে জাল কেটে তাদেরকে রক্ষা করি। কিন্তু মাঝেমধ্যে আবার না দেখেও কাছিম জালে আটকা পড়ে মারা যায়। কিন্তু সবসময় চেষ্টা করি, কাছিমকে রক্ষা করতে।’

উখিয়ার রেজুখাল উপকূলের বাসিন্দা নুরুল আলম মাঝি বলেন, ‘কাছিম আর ডলফিন মারা যাচ্ছে বড় বড় ট্রলিংয়ের কারণে। তারা তো একটানা ৩ ঘণ্টা জাল টানে। এসব জালে কাছিম ঢুকে পড়লে মারা যায়। এছাড়া উপকূলের কাছাকাছি কিছু বিহিন্দি জাল বসায়, এগুলোতেও আটকা পড়ে কাছিম মারা যাচ্ছে।’

কক্সবাজার শহর, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও সোনাদিয়া সৈকত থেকে মৃত কাছিম ভেসে আসছে বেশি। প্রতিটি কাছিমই মা কাছিম এবং যারা ডিম পাড়তে উপকূলে বালিয়াড়িতে আসতে গিয়ে মৃত্যু হচ্ছে। এত বেশি সংখ্যায় কাছিমের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলেছে সমুদ্রবিজ্ঞানীদের।

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. শিমুল ভূঁইয়া বলেন, ‘গত প্রায় দুই মাস ধরেই কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ভেসে আসছিল মৃত মা কাছিম। এগুলোর পেটে পাওয়া যাচ্ছিল ডিম। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মোট ১০৩টি মৃত কাছিম ভেসে এসেছে। এর মধ্যে গত ১৪ দিনেই সমুদ্রের তীরে পাওয়া যায় ৯২টি মৃত মা কাছিম। যেগুলোতে সংগ্রহ করা হয়েছে ৯ হাজারের বেশি ডিম। তবে এত বেশি মা কাছিমের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলছে।’

বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এখন কাছিমের প্রজনন মৌসুম। সাধারণত নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত তারা ডিম দেয়। উপকূলে এসে গর্ত করে ডিম পেড়ে মাটি চাপা দিয়ে তারা আবার সাগরে ফিরে যায়। এরপর প্রাকৃতিকভাবেই ডিমগুলো থেকে বাচ্চা ফুটে সাগরে ফিরে যায়। তবে অনেকসময় কুকুর খেয়ে ফেলাসহ আরও নানাভাবে এসব ডিম নষ্ট হয়ে যায়। তাই এগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে কয়েকটি সংস্থা। সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা কাছিমের ডিম সংগ্রহ করে নিজস্ব হ্যাচারিতে সংরক্ষণ শুরু করে। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হলে তারা সেগুলো সাগরে ছেড়ে দেয়।

এদিকে এরইমধ্যে সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক মৃত মা কাছিমের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। মারা যাওয়ার প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানে সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা।

পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে মৃত কাছিম পাওয়া যাচ্ছে। এসব কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকে। সাগরে পুঁতে রাখা মাছ ধরার জালে আটকা পড়লে জেলেরা লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে কিংবা ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে কাছিমকে হত্যা করে সমুদ্রে নিক্ষেপ করে। জোয়ারের পানিতে কাছিমগুলো উপকূলে ভেসে এলে কুকুর খেয়ে ফেলেছে। জেলেদের সচেতন করা, ডিম দেয়ার স্থানটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি এবং সৈকতে কুকুরের বিচরণ রোধ করা জরুরি। তা না হলে কাছিম রক্ষা করা যাবে না।’

সাগরে মা কাছিম মারা যাওয়ার এমন পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ।

তিনি বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে ভেসে আসা মৃত সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর নমুনা সংগ্রহ করে মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এমনটা আগে কখনও হয়নি। একদল গবেষককে সাগরেও পাঠানো হচ্ছে কারণ অনুসন্ধানে।’

গত দু’মাসে কক্সবাজার উপকূলে মৃত অবস্থায় ভেসে এসেছে ১০৩টি মা কাছিম ও ৫টি বিরল প্রজাপতির ডলফিন।

সর্বশেষ খবর