দেশে প্রায় পৌনে চার কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ তামাক ব্যবহারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। একই সঙ্গে কর্মক্ষেত্রসহ জনসমাগমস্থল ও গণপরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন আরও তিন কোটি ৮৪ লাখ মানুষ। তামাকের বহুল ব্যবহার হৃদরোগ, ক্যানসার, বক্ষব্যাধি এবং অন্যান্য অনেক অপ্রতিরোধযোগ্য রোগ ও মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। তারপরও তামাকের ভয়াবহ আগ্রাসন থামছে না কেন, জানে না সচেতন মহলও।
এছাড়া গবেষণায় দেখা যায়, তামাকজনিত রোগে প্রতি বছর দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। তারপরও কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না তামাকের আগ্রাসন।
জানা যায়, তামাকজাত কোম্পানিগুলোর নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধার পাশাপাশি দাম ভালো পাওয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি জেনেও তামাক চাষে ঝুঁকছেন চাষিরা। একই সঙ্গে বিকল্প ফসল উৎপাদনে খরচ বেশি ও ন্যায্যমূল্যের নিশ্চয়তা না থাকায় তামাক চাষে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের। চলতি বছর রংপুর কৃষি অঞ্চলে তামাকের চাষ হয়েছে ১৩ হাজার ৯৪৯ হেক্টর জমিতে। গতবছর যা ছিল ১০ হাজার ৮২০ হেক্টর।
রংপুর সদর উপজেলার হরিদেবপুর ইউনিয়নের কৃষক বাদশারুল ইসলাম। এ বছর প্রায় চার বিঘা জমিতে করেছেন তামাকের আবাদ। অথচ গতবছরও ই জমিগুলোতে আলু লাগিয়েছিলেন তিনি। সময় সংবাদকে বাদশারুল ইসলাম বলেন, ‘গত চার-পাঁচ বছর ধরে এ জমিগুলোতে আলু চাষ করছি। তবে এবার আলুর বীজের যে দাম, সঙ্গে সার কীটনাশকও আছে, তাই কোম্পানি থেকে টাকা নিয়ে তামাক লাগাইছি। এখন আর লোকসানের চিন্তা নাই।’
বাদশারুল ইসলামের মতো জেলার বেশিরভাগ কৃষকই এবার আলুর জমিতে চাষ করেছেন তামাক। কৃষকরা বলেন, অন্যান্য ফসল চাষে বীজ, সার, সেচসহ উৎপাদন খরচ বাড়ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন তামাকজাত কোম্পানি তামাক চাষে নানা রকম সহায়তা করছে। যে কারণে ক্ষতি জেনেও তামাক চাষ করছেন তারা।
রংপুরে জমি থেকে তামাক তুলে বাজারে যাচ্ছেন কৃষকরা। ছবি: সময় সংবাদ
খলেয়া ইউনিয়নের শহিদুল ইসলাম ও আশরাফুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে সময় সংবাদকে তারা বলেন, ‘অন্য ফসল চাষে খরচ বেড়েছে কয়েক গুণ। তার ওপর ফসল উৎপাদন করে সঠিক দাম পাই না আমরা। যে কারণে তামাক চাষ করি। সিগারেটের কোম্পানিগুলো সুদ ছাড়া আগাম লোন দেয়, তামাক আবাদের জন্য। আর দাম নিয়ে চিন্তাও করা লাগে না।’
সরেজমিনে রংপুর জেলার সদর, গংগাচড়া, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুরসহ বেশ কয়েকটি উপজেলা ঘুরে একই চিত্র পাওয়া গেছে। বছরের এই সময়ে জমিগুলোতে আলুসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা হলেও এবার তার ভিন্ন চিত্র ফুটে উঠেছে। ফসলের অধিক দাম আর তামাকজাত কোম্পানিগুলোর বিভিন্ন সহায়তার কারণে বেড়েই চলেছে তামাকের আগ্রাসন। তবে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক।
দীর্ঘ সময় রংপুর অঞ্চলে তামাকের যে আগ্রাসন সেটি কমাতে নানা উদ্যোগ নিলেও সফলতা খুব একটা আসেনি। তবে এবার তিস্তার বিস্তীর্ণ চরে পরীক্ষামূলকভাবে তামাকের পরিবর্তে গম ও ভুট্টা চাষ বাড়াতে নেয়া হয়েছে উদ্যোগ। এতে করে কৃষকরা যেমন কয়েকগুণ বেশি লাভবান হবেন; তেমনি তামাকের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে পরিবেশ ও প্রতিবেশ।
পল্লী উন্নয়ন একাডেমি বগুড়ার অতিরিক্ত মহাপরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘দেশের কৃষি জমির পরিমাণ যেভাবে কমে আসছে তাতে আমরা শঙ্কিত। সেই সঙ্গে তামাক চাষের কারণে কৃষিজমির উর্বরতা নষ্ট হওয়াসহ বাড়ছে কৃষকদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। তাই আমরা কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে এবার গম ও ভুট্টা চাষে উৎসাহ দিচ্ছি। আপাতত তিস্তার ৪০০ কৃষককে সার, বীজ, সেচ সুবিধাসহ প্রশিক্ষণ ও কৃষিঋণ দেয়া হয়েছে। একশ একর জমিতে তামাক বাদ দিয়ে চাষ করা হয়েছ গম ভুট্টা। আশাকরি ছোট ছোট কৃষি লোনের মাধ্যমে আমরা আরও কৃষককে এ প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে পারবো।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু ফারাহ মো. নাছের বলেন, আরডিএর মাধ্যমে কৃষকদের তামাকের পরিবর্তে গম ও ভুট্টা চাষে উদ্বুদ্ধ করতে পরীক্ষামূলকভাবে যে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে তা সফল হলো আমাদের কৃষকদের যেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা বৃদ্ধি পাবে তেমনি গম ও ভুট্টার ফলন বাড়ানো গেলে আমাদের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা বেঁচে যাবে।