Homeআন্তর্জাতিকক্ষমতার মসনদে শাহবাজ ও জারদারি, হেরেও ‘জিতলেন’ ইমরান!

ক্ষমতার মসনদে শাহবাজ ও জারদারি, হেরেও ‘জিতলেন’ ইমরান!

পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচনের প্রায় দুসপ্তাহ পর সম্ভাব্য নতুন সরকারের রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। ঐতিহ্যগতভাবে একে অপরের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) নির্বাচনে এককভাবে ভালো ফলাফল করতে ব্যর্থ হলেও ক্ষমতা ভাগাভাগির মাধ্যমে জোট সরকার গড়তে যাচ্ছে।

এদিকে, নজিরবিহীন দমনপীড়নের মধ্যে নির্বাচনে সবার চেয়ে এগিয়ে থেকেও সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছে কারাবন্দি জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)। সরকার গঠন করতে না পারার বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে ইমরান খানের ‘পরাজয়’ মনে হলেও প্রকৃত বিচারে তিনিই জিতেছেন।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচনে ভোটগ্রহণ করা হয়। কিন্তু ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর সময়মতো ফল প্রকাশ করা হয়নি। ফল প্রকাশ শুরু হয় ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ১২ ঘণ্টা পর। আবার ফল প্রকাশ শুরু হলেও তা ছিল অতি মন্থর গতিতে। ফলে পাকিস্তানি ভোটাররা সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠেন, ‘নিশ্চয়ই অনিয়ম ও কারচুপি করা হচ্ছে।’

এ নির্বাচনে রাজনীতিতে ‘আজীবন নিষিদ্ধ’ সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও তার দল পাকিস্তান মুসলিম লীগকে (পিএমএল-এন) জেতানোর সব ব্যবস্থাই করা হয়। কিন্তু যে পিটিআইর নিবন্ধন বাতিল করে, নির্বাচনী প্রতীক কেড়ে নিয়ে তাদের নেতাদের ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে বাধ্য করা হয়েছিল, নির্বাচনের ফলে দেখা গেল, সেই দলের প্রার্থীরাই ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে বেশি আসন পেয়েছে।

কিন্তু বেশি আসন পেয়েও সরকার গঠন করতে পারছে না পিটিআই। কারণ সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা তথা ১৩৪টি আসন পায়নি দলটি। পেয়েছে ৯৩টি। পিএমএল-এন পেয়েছে ৭৫টি। আর তরুণ রাজনীতিক বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছে মাত্র ৫৪টি।

২০২২ সালে ইমরান খান সরকার উৎখাতের পর যে জোট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তার নেতৃত্বে ছিল পিএমএল-এন ও পিপিপি। এ দল দুটি ছোট ছোট আরও কয়েকটি দলকে সঙ্গে নিয়ে আবারও জোট সরকার গড়ন করতে যাচ্ছে।

প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে দফায় দফায় দর কষাকষির পর অবশেষে জোট সরকার গঠনে একমত হয়েছেন দুল দুটির নেতারা। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে পিএমএল-এন ও পিপিপির সম্মিলিত আসনসংখ্যা ১৫০ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যেখানে ২৬৬টি আসনের মধ্যে সরকার গড়তে তাদের দরকার ১৩৪টি।

জোট সরকারে ক্ষমতা ভাগাভাগির বিষয়ও চূড়ান্ত হয়ে গেছে। ডনের প্রতিবেদন মতে, নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হবেন সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের ছোট ভাই পিএমএল-এন নেতা শাহবাজ শরিফ। প্রেসিডেন্ট হবেন পিপিপির নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির বাবা দলের কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলী জারদারি।

এ সরকারকে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) জোট সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদ বলা হচ্ছে। ২০২২ সালে ইমরান খানের পিটিআই সরকারকে উৎখাত করার পর জোট সরকার গঠন করে পিডিএম, যার প্রধানমন্ত্রী হন পিএমএল-এনের শাহবাজ। তবে জোট সরকার হলেও তা কতদিন টিকবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

পিএমএল-এন-পিপিপির পাশাপাশি শুরু থেকেই সরকার গঠনের চেষ্টা অব্যাহত রাখলেও এখন পর্যন্ত জোট সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা কোনোটাই অর্জন করতে পারেনি ইমরান খানের পিটিআই। আপাতদৃষ্টিতে এটাকে ইমরান খানের ‘হার’ মনে হলেও প্রকৃত বিচারে এটা তার স্পষ্ট বিজয়।

নির্বাচন সামনে করে ইমরান খানসহ দলটির প্রধান প্রধান নেতাকে শত শত মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে। শুধু তাই নয়, দুর্নীতির মামলায় কারাগারে ভরা হয়েছে। দলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। কেড়ে নেয়া হয়েছে নির্বাচনী প্রতীক। বাধ্য করা হয়েছে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়াতে।

এমন পরিস্থিতিতে অনেক বিশ্লেষকই ধরে নিয়েছিলেন, নির্বাচনের মধ্যদিয়ে পিটিআই ‘নিশ্চিহ্ণ’ হয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপক দমনপীড়নের মধ্যেও নির্বাচনের ফলাফলে বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবীকে ভুল প্রমাণ করে তাক লাগিয়েছে দলটি।

পিটিআই নেতাকর্মীরা নির্বাচনের পর থেকেই বলে আসছেন, জনগণ তাদের ম্যান্ডেট (জনসমর্থন) দিয়েছেন, তা চুরি করা হয়েছে। তারা আরও বলছেন, ফর্ম ৪৫ অনুযায়ী তাদের প্রার্থীরা আসলে ১৭০- থেকে ১৮০টি আসনে জয় পেয়েছেন। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন মাত্র ৯৩ টি আসনের কথা স্বীকার করছে। বাকি আসনগুলো ‘চুরি করা হয়েছে‘। সেই চুরি করা আসনগুলো নিয়েই সরকার গড়তে যাচ্ছে পিপিপি-পিএমএল-এন।

কারচুপির এ অভিযোগে নির্বাচনের পরদিন থেকেই বিক্ষোভ করছেন পিটিআই নেতাকর্মীরা। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছেন জামায়াতে ইসলামি (জেআই) ও জমিয়ত উলামা ইসলামের (জেইউআই-এফ) নেতাকর্মীরাও। এসব পাকিস্তানজুড়ে শহরে শহরে এসব বিক্ষোভে প্রতিদিন অংশ নেন লাখ লাখ সাধারণ জনতা। বিক্ষোভ-আন্দোলনে যখন পুরো পাকিস্তান উত্তপ্ত, তখন সরকারের এক আমলা সব গোমর ফাঁস করে দেন।

পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রদেশ পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডিতেই জোর করে ফেল করানো হয়েছে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের। গত শনিবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) সংবাদ সম্মেলন করে সে কথাই বলেন রাওয়ালপিন্ডি ডিভিশন কমিশনার (ডিসি) লিয়াকত আলি চাট্টা।

ভোট গণনায় কারচুপি হয়েছে স্বীকার করে ডিসি বলেন, যেসব প্রার্থী ৭০ হাজার ভোটে জয়ের পথে ছিলেন আমরা তাদের ৫০ হাজার ভোটে নামিয়ে হারিয়ে দিয়েছি। তিনি আরও বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং প্রধান বিচারপতিও এর সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিলেন। শনিবার এ অভিযোগ স্বীকার করে পদত্যাগও করেন তিনি। এর ঘণ্টা কয়েক পরই তিনি গ্রেফতার হন।

নির্বাচনের অনিয়ম ও ফল কারচুপি নিয়ে বিক্ষোভ-আন্দোলন ও বক্তব্য-বিবৃতি এখনও অব্যাহত রয়েছে। পিটিআই চেয়ারম্যান গহর আলি খান বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) বলেন, পাকিস্তানি জনগণের ম্যান্ডেট (জনসমর্থন) অনুযায়ী পিটিআইকেই কেন্দ্রে, পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়ায় সরকার গড়তে দেয়া উচিত।
এদিক জামায়াতে ইসলামির (জেআই) নেতা সিরাজুল হক প্রধান নির্বাচনারের পদত্যাগ দাবি করেছেন। সেই সঙ্গে ফল কারচুপির অভিযোগ তদন্তে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। পিএমএল-এন ও পিপিপির সম্ভাব্য জোট সরকারের সমালোচনা করে এই নেতা বলেন, দুই পরিবারের শাসন পাকিস্তানের ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।

এদিকে সিন্ধু হাইকোর্টের (এসএইচসি) প্রধান বিচারপতি আকিল আহমেদ আব্বাসি প্রশ্ন রেখে বলেছেন, যখন ড্রয়িংরুমের আলোচনায় সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, তখন এত আয়োজন করে নির্বাচন করার কি দরকার। নির্বাচনের দিন ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়া নিয়ে বুধবার (২১ ফেব্রুয়ারি) এক শুনানির সময় এ কথা বলেন তিনি।

বিচারক আকিল আহমেদ আব্বাসির কথায়, কে প্রেসিডেন্ট হবেন, কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, কে গভর্নর পদ পাবেন; এটা যদি ড্রয়িংরুমে বসেই হয়, তাহলে নির্বাচন কেন করা হলো? তিনি আরও বলেন, মনে হচ্ছে আদালতগুলো অকেজো হয়ে গেছে। আদালতকে গুরুত্ব সহকারে নেয়া হচ্ছে না বলেও আক্ষেপ করেন এই বিচারক।

এদিকে পিটিআই নেতারা ‘স্বতন্ত্র’ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়ায় পিটিআইর সামনে বেশ কিছু আইনি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছিল। দল হিসেবে নির্বাচনে অংশ না নিতে পারায় পার্লামেন্টের সংরক্ষিত আসনের কোটা সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা ঝুঁকি ছিল। কারণ সংরক্ষিণ আসনের কোটা সুবিধা সরাসরি ভোটে কোনো দলের প্রাপ্ত আসনের হারের ওপর ভিত্তি করে দেয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত সেই ঝুঁকি অনেকেটাই কেটে গেছে।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের মতে, পিটিআই মজলিশ ওয়াহদাত-ই-মুসলিমিন (এমডব্লিউএম) ও সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিল (এসআইসি) নামে দুটি দলের সাথে জোট গড়তে সক্ষম হয়েছে। তবে এবারের নির্বাচনে দলটি কোনো আসন জিততে পারেনি।

এর ফলে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত আসনগুলোর পাশাপাশি সংরক্ষিত ৭০টি আসনের মধ্যে প্রায় ২৪টি আসন পাওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে আসনগুলো পেতে পিটিআইকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

Exit mobile version