আধিপত্য ধরে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যেকোনো ‘কৌশল’ নিতে পারে, সেটি এখন ‘ওপেন সিক্রেট’। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। নিজ স্বার্থ উদ্ধারে অবস্থান পাল্টাতেও যে যুক্তরাষ্ট্রের সময় লাগে না, তার বড় প্রমাণ বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে ও পরে মার্কিন কর্মকর্তাদের বিভিন্ন বক্তব্য। তবে বাংলাদেশকে নিয়ে বাইডেন প্রশাসন এবার নতুন খেলায় মেতেছে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে বাংলাদেশকে অপরিহার্য অংশীদার মনে করে ওয়াশিংটন। যদিও এক্ষেত্রে চীনকে বড় ‘বাধা’ হিসেবে দেখে দেশটি। কারণ ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে বেইজিং, যা ভালো চোখে দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র। আবার বেইজিংয়ের সঙ্গে সম্পর্ক মধুর নয় ভারতের। বাংলাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে তাই উদ্বেগ রয়েছে দিল্লিরও।
বিশ্লেষকদের ধারণা, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশকে চীনা বলয় থেকে মুক্ত করতে হাত মেলাতে পারে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র; যার নেপথ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু।
ডোনাল্ড লু’র সাম্প্রতিক বক্তব্য থেকেও বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট। তিনি বলেছেন, দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে উদারতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। তবে চলমান মিয়ানমার সংকট নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতকে সতর্ক করেছেন মার্কিন এ কূটনীতিক।
তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট ও মিয়ানমারে চলমান অস্থিরতার কারণে যে নিরাপত্তা হুমকি তৈরি হয়েছে, তা আরও খারাপ হবে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এর প্রভাব পড়বে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রশাসনের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল ও পেন্টাগন কর্মকর্তাদের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে এসব কথা বলেন লু।
বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী দেশ মিয়ানমারে এই মুহূর্তে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। দেশটির সেনাশাসিত সরকার ও গণতন্ত্রপন্থিদের মধ্যে চলছে সশস্ত্র সংঘাত। সম্প্রতি জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তা চরম রূপ নিয়েছে। ফলে রোহিঙ্গা সংকটের পাশাপাশি মিয়ানমারের চলমান অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে ডোনাল্ড লু ওয়াশিংটনভিত্তিক সরকারি গবেষণা সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস (ইউএসআইপি) আয়োজিত বৈঠকে বলেছেন, মিয়ানমার পরিস্থিতির সহসাই উন্নতি হচ্ছে না। এ কারণে বাংলাদেশ ও সম্ভবত ভারতের জন্যও যে শরণার্থী সংকট ও নিরাপত্তা সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের শঙ্কা আছে; যা সামনে আরও গভীর হতে পারে।
এদিকে ইকোনমিস্টসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, মিয়ানমার ইস্যুতে দ্বৈত নীতি অনুসরণ করছে চীন। অর্থাৎ মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারকে সহযোগিতা করার পাশাপাশি আরাকান আর্মিসহ বিদ্রোহীদেরও পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে বেইজিং।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাণিজ্যিক স্বার্থের পাশাপাশি মিয়ানমার নিয়ে আগে থেকেই চীনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই বিভিন্ন সময় পশ্চিমাদের হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করেও জান্তা বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে এসেছে শি প্রশাসন। আর চীনের এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব আরও খর্ব হবে বলেই শঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের। একইভাবে নিজেদের অবস্থান দুর্বল হয়ে যেতে পারে বলে মনে করে ভারতও। এসব কারণেই মিয়ানমার ইস্যু সামনে রেখে চীনকে মোকাবিলায় হাত মেলাতে পারে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র।
সম্প্রতি মিয়ানমারের অন্তত ৬০০ সেনা পালিয়ে ভারতে যায়। এরপরই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মিয়ানমারের এই ইস্যুসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল।
গেল ৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তার আগের সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেছেন। শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর এটাই ছিল ভারতের উচ্চ পর্যায়ের কারও প্রথম ঢাকা সফর।
তবে অজিত দোভালের এই সফর আনুষ্ঠানিক বা অঘোষিত ছিল বলেও জানায় টাইমস অব ইন্ডিয়া। তার সফর সংক্রান্ত কোনো পূর্বঘোষণা ঢাকা বা নয়াদিল্লি- কোনো পক্ষই দেয়নি। সূত্রের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনে তখন বলা হয়, নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা করতে বাংলাদেশে এসেছিলেন অজিত দোভাল। এসময় মিয়ানমার সীমান্ত সমস্যা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অনেক সম্পর্ক বিশ্লেষকের মতে, মিয়ানমার ইস্যুকে সামনে রেখে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র যে এক হয়ে কাজ করতে চায়; অজিত দোভালের আকস্মিক সফরের পর ডোনাল্ড লু’র মন্তব্যই তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত।
কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে চীনের পরিকল্পনা আসলে কী? শ্রীলঙ্কা স্মরণকালের ভয়াবহ আর্থিক সংকটে নিমজ্জিত হওয়ার পর চীনের ‘ঋণের ফাঁদ’ নিয়ে শুরু হয় জোর আলোচনা। অভিযোগ ওঠে, অর্থ-সাহায্য দিয়ে বিভিন্ন দেশকে কার্যত নিজেদের ‘বশে’ নিয়ে আসতে চায় বেইজিং। পাকিস্তান ইতোমধ্যেই সেই ‘ফাঁদে’ পা দিয়ে রেখেছে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে’র নামে। তালিকায় নাম আছে মালদ্বীপেরও। বাংলাদেশকেও কি একইভাবে হাতে রাখতে চায় চীন?
কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বলছে, মিয়ানমারের ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশকে চাপে ফেলা এবং অর্থনৈতিক সংকটকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে মালদ্বীপ বা শ্রীলঙ্কার মতো একটি পরিস্থিতি চীন তৈরি করতে পারে, সেই ধারণা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায়না। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সজাগ রয়েছে বলেই কূটনীতিক সূত্র থেকে বলা হচ্ছে।
তবে মিয়ানমারের অস্থিতিশীলতা বাংলাদেশের জন্য নিরাপত্তা হুমকি এবং নতুন শরণার্থী চাপ তৈরি করতে পারে বলে শঙ্কা রয়েছে। সে কারণে ঢাকা এখন থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভারতের সঙ্গে অভিন্নভাবে কাজ শুরু করতে চায় বলে সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছে বিভিন্ন সূত্র।