Homeআন্তর্জাতিকসেনার আশীর্বাদ সত্ত্বেও কেন জিততে পারলেন না নওয়াজ

সেনার আশীর্বাদ সত্ত্বেও কেন জিততে পারলেন না নওয়াজ

তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর দল নির্বাচনের মাঠে মুখ থুবড়ে পড়েছে। শীর্ষে উঠে এসেছেন কারাবন্দি নেতা ইমরান খানের সমর্থিত প্রার্থীরা। এখন সরকার গড়তে গিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখে পড়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ।

প্রায় দুই বছরের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পর গত বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) পাকিস্তানে বহুল কাঙিক্ষত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। সহিংসতা আর নানা অনিয়ম ও অভিযোগের মধ্যদিয়ে শেষ হয় ভোটগ্রহণ।
এরপর এলো ফলাফল প্রকাশের পালা। কিন্তু এক্ষেত্রেও শুরু হলো টালবাহানা। অবশেষে ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার ১২ ঘণ্টা পর শুরু হলো বেসরকারি ফলাফল প্রকাশ। তবে খুবই ধীর গতিতে।

শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) যতটুকুই ফলাফল সামনে এলো, তাতে দেখো বড় ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন কারাবন্দি নেতা ইমরান খানের পিটিআই-সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। অনেক পিছিয়ে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল-এন)। কিন্তু পিছিয়ে থেকেও ‘বিজয় ভাষণ’ দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন দলটির নেতা নওয়াজ শরিফ।

এরপর এদিন রাতেই লাহোরে দলের সদরদফতরের বেলকনিতে সপরিবারে হাজির হলেন তিনি। তার আগমনে আতশবাজি জ্বলে উঠলো। আলোকিত হলো রাতের আকাশ। সেই সুযোগে তাকে স্বাগত জানালো প্রায় হাজার দেড়েক ‘অনুগত’ কর্মী-সমর্থক। যারা আগেই পার্টি অফিসের সামনে জড়ো হয়েছিলেন।

নওয়াজ তার কর্মী-সমর্থকদের ‘বিজয় ভাষণ’ দিতে শুরু করলেন। যা বললেন তা প্রায় প্রতিটি জনসভায় বলে থাকেন তিনি। ক্ষুদ্র জনসমাবেশকে উদ্দেশ করে নিজের সেই পুরনো বাক্যটাই ছাড়লেন। বললেন, আপনারা কি আমাকে ভালবাসেন? ক্ষুদ্র সমাবেশ থেকে সমস্বরে জবাব এলো, আমরা আপনাকে ভালোবাসি।

প্রশ্ন হতে পারে, সুবিধাভোগী কিছু অনুগত কর্মী-সমর্থক ছাড়া পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ কি নওয়াজকে ভালবাসে? পাকিস্তানের গত ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন ও এর পরবর্তী কয়েকদিনের পরিস্থিতির দিকে একটু খেয়াল করলেই এই প্রশ্নের জবাব স্পষ্ট হয়ে যাবে।

নওয়াজের অনুগত কর্মীসমর্থকদের মতো পাকিস্তানের সাধারণ জনগণও যে তাকে ভালবাসে, তার প্রমাণ খুবই পাওয়া গেছে। প্রায় ২৫ কোটি জনগণের মধ্যে ১২ কোটির বেশি নিবন্ধিত ভোটার গত ৮ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনের দিনই দেখিয়ে দিয়েছেন, তারা নওয়াজ কে কতটা ঘৃণা করেন। যা তাবড় তাবড় রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মুখে রীতিমতো ঝামা ঘসে দিয়েছে।

নির্বাচন হতে তখনও কয়েক সপ্তাহ বাকি। বাঘা বাঘা রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা টকশো মাতিয়ে বললেন, এবার পিএমএল-এনই জয় পেতে যাচ্ছে। ৭৪ বছর বয়সী নওয়াজই আরও একবার পাকিস্তান শাসন করবেন। অবশ্য তাদের এমন মাতামাতির কারণও ছিল। আর সেটা হলো পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর আশীর্বাদ।

পানামা পেপার্স কেলেঙ্কারির জেরে দুর্নীতির অভিযোগে নওয়াজ ১০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। এরপর ‘আজীবনের জন্য’ রাজনীতিতে ও সরকারি পদে নিষিদ্ধ হন। সেই সাজা মাথায় করে ইমরান খান সরকারের অনুমতিক্রমে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান তিনি। গিয়ে আর ফিরে আসেননি। থেকে যান স্বেচ্ছা নির্বাসনে।

প্রায় চার বছর পর নির্বাচন সামনে করে গত বছরের শেষদিকে দেশে ফেরেন নওয়াজ। এরপর তার বিরুদ্ধে যত মামলা ছিল, দ্রুতই সব খালাস করা হয়। তিনি যে ‘আজীবনের জন্য’ রাজনীতিতে নিষিদ্ধ ছিলেন, সেই নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেয়া হয়। এর মধ্যদিয়ে মূলত তার নির্বাচনে অংশ নেয়া ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথই পরিষ্কার করা হয়।

অন্যদিকে ২০২২ সালে পিটিআই নেতৃত্বাধীন ইমরান খানের সরকারের পতনের পর থেকে তার বিরুদ্ধে ডজন ডজন মামলা দেয়া হয়। অবশেষে নির্বাচন সামনে করে দুর্নীতির মামলায় তাকে কারাগারে ভরা হয়।

শুধু তাই নয়, পিটিআই’র দলীয় নিবন্ধন বাতিল করে নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ রুদ্ধ করা হয়। কেড়ে নেয়া হয় নির্বাচনী প্রতীক ক্রিকেট ব্যাটও। এসবের জন্য পিটিআই নেতারা বরাবরই সেনাবাহিনীকেই অভিযুক্ত করে এসেছেন।

সবমিলিয়ে পাকিস্তান জাতীয় নির্বাচন ২০২৪-এ নওয়াজ শরিফ ও তার দল পিএমএল-এন জেনারেলদের ‘ফেভার’ পেয়েছেন এমনটাই জনপ্রিয় মত। আর এ কারণেই ‘বড় মিয়া’ ও তার দলবল তাদের জয়ের ব্যাপারে অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলেন।

এবং সেই আত্মবিশ্বাস এতটাই বেশি ছিল যে, ভোটের দিন (৮ ফেব্রুয়ারি) রাতেই অর্থাৎ ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই দল তাদের নেতার ‘বিজয় ভাষণ’র সময়ও ঠিক করে রেখেছিল।

কিন্তু এরপর যখন ফলাফল আসতে শুরু করলো, নওয়াজ, তার পরিবার ও দলবলের উচ্ছ্বাস কর্পূরের মতো উবে গেল। যেমনটা বলছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ মজিদ নিজামী। তিনি বলেন, ‘যখন ভোটের ফলাফল সামনে আসতে লাগলো, পিএমএল-এন হতবাক হলো। এজন্যই তারা ‘বিজয় ভাষণ’র ব্যাপারে নতুন করে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেন এবং প্রায় ১২ ঘন্টা সম্পূর্ণ নীরব ছিল।

যে ‘বিজয় ভাষণ’ ভোট শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দেয়ার কথা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তা দেয়া হলো প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর। শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) রাতে নওয়াজ সপরিবারে ‘বিজয় ভাষণ’ দিতে দলের সদরদফতরের বেলকোনিতে এলেন। বিজয়ও দাবি করলেন। কিন্তু স্বীকার করলেন যে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। আর তাই সরকার গঠনে জোটের প্রয়োজন হবে।

মজিদ নিজামী বলেন, কোনোভাবেই এমন ফল আশা করেনি পিএমএল-এন। তারা ভেবেছিল, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে তারা পাঞ্জাব প্রদেশ থেকেই ৮৫ শতাংশের বেশি আসন পাবে। কিন্তু প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেলো যে, তারা মাত্র ৫০ শতাংশ আসন পেয়েছে।

পাঞ্জাব শরিফ পরিবার ও পিএমএলএন-এর ঘাঁটি। সেই ঘাঁটিতেই বাকি আসনগুলোর প্রায় সবকটিই ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত প্রার্থীদের দখলে চলে গেছে। কিন্তু নির্বাচন সামনে করে দলটির নেতাকর্মীদের ওপর এতটাই দমনপীড়ন চালানো হয়েছিল যে অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেছিলেন যে, দলটি ধ্বংস হয়ে গেছে।

তিনদিন পর রোববার (১১ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে যখন নির্বাচনের ফলাফল বের হলো, তখন দেখা গেল, ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির ২৬৫ আসনের মধ্যে নওয়াজের দল পিএমএল-এন মাত্র ৭৫টি আসন পেয়েছে। পিটিআই সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রাপ্ত মোট আসন থেকে অন্তত ২৫টি কম। পিটিআই’র অভিযোগ, নির্বাচনের ফল কারচুপি করা হয়েছে।

দলটির নেতারা বলছেন, তাদের প্রার্থীরা অন্তত ১৭০টি আসন জিতেছেন। কিন্তু ফল কারচুপির মাধ্যমে তাদেরকে প্রয়োজনীয়তা সংখ্যাগরিষ্ঠতা (এককভাবে সরকার গড়তে ১৩৪ আসন দরকার) থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।

পাকিস্তানি জনগণ পিটিআইকে যে ম্যান্ডেট (জনসমর্থন) দিয়েছে তা নওয়াজ ও তার দল পিএমএল-এনের জন্য ‘চুরি করা হয়েছে’। ফল কারচুপির বিরুদ্ধে এরই মধ্যে রাজপথে নেমেছেন দলটির নেতাকর্মীরা। নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) ও আদালতে লিখিত অভিযোগও দায়ের করেছেন।

কেন ব্যর্থ হলো পিএমএল-এন?

নিশ্চিতভাবেই এটা অনেক বড় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রভাবশালী সেনাবাহিনীর আশীর্বাদের পরও কী এমন ঘটলো যে, পাকিস্তানি জনগণ মুখ ফিরিয়ে নিলো? অথচ ২০২২ সালের শুরুর দিকেও বেশির জনমত জরিপেই পিটিআই’র চেয়ে জনপ্রিয়তায় এগিয়ে ছিল পিএমএল-এন। এছাড়া পাঞ্জাবেও দলটির অবস্থান আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী বলেই বিবেচনা করা হচ্ছিল।

লাহোরভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বদর আলম বলছেন, পিএমএল-এনের এই হতাশাজনক ফলাফলের শিকড় ২০২২ সালের এপ্রিল ও এর পরবর্তী ঘটনাবলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। যখন অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরান খান ও তার পিটিআই নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করা হয়।

আলম বলেন, সেই সময় নওয়াজ শরিফ লন্ডনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে। তার দল পিএমএল-এন, পাকিস্তান পিপল’স পার্টি (পিপিপি) ও সমমনা আরও কয়েকটি দল ইমরান খানের পতনে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট (পিডিএম) নামে আন্দোলন গড়ে তোলে। তারা সফলও হয়। কিন্তু নওয়াজের ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ যখনই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন, তার সব মনযোগ চলে গেল বড় ভাইকে সব মামলা ও দণ্ড থেকে মুক্ত করার দিকে।

এই মামলাগুলো শরিফদেরকে গত প্রায় তিন দশক ধরে তাড়া করে ফিরছে। বড় ভাই নওয়াজ শরিফ ১৯৯০-এর দশকে দুইবার দেশ শাসনের সুযোগ পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ সেই তখন থেকেই। ১৯৯৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতাকচ্যুত করা হয়।

এরপর প্রায় ১৪ বছর পর ২০১৩ সালে আবারও ক্ষমতায় ফেরেন তিনি। কিন্তু ইমরান খানের পিটিআই’র তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ তার পিছু ছাড়েনি। সেই দুর্নীতির অভিযোগেই ২০১৭ সালে তাকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেয় পাকিস্তানের দুর্নীতি দমন বিষক ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি বোর্ড (ন্যাব)।

এরপর অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে পিটিআই’র কাছে হারলো পিএমএল-এন। প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পান ইমরান খান। কিন্তু তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পেছনেও সেনাবাহিনীর সমর্থন ছিল। কিন্তু অল্পদিনেই খান ও সেনাবাহিনীর মধ্যকার সম্পর্ক তীক্ত হয়ে ওঠে এবং অবশেষে ২০২২ সালের এপ্রিলে তাকে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান।

মনে করা হয়, খানের পতনের পর পিএমএল-এন ও পিপিপির যে জোট সরকার ক্ষমতায় আসে তাতে হাত ছিল সেনাবাহিনীর। এরপরই পাকিস্তান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সংকটের মধ্যে পড়ে এবং সময়ের পরিক্রমায় সেই সংকট বেড়েছে বই কমেনি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সালমান গনি বলেন, পিডিএম জোটের প্রধান দল হওয়ার কারণে সরকারের সব সিদ্ধান্ত নিতেন শরিফ ভাইয়েরা।

এই বিশ্লেষক বলেন, পিডিএম জোটের ১৬ মাসের শাসনকালে পিএমএল-এনের অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। এই সরকারের অধীনেই পাকিস্তানে ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি দেখা গেছে। যা সাধারণ জনসাধারণের জীবনে নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছে। যার পরিণামে ভোটব্যাংক সংকুচিত হয়েছে।

সালমান গনির মতে, ‘পিএমএল-এন উন্নয়ন ও অর্থনীতির দল; মানুষ আর্থসামাজিকভাবে সুবিধা পাওয়ার জন্যই দেলটিকে সমর্থন করে, আদর্শের জন্য নয়। কিন্তু ১৬ মাসের শাসনকালে মানুষের সেই উপলব্ধিটি ধ্বংস হয়ে গেছে।’

পাকিস্তানের অর্থনীতির অবস্থা এখন শোচনীয়। গত বছর ঋণখেলাপি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল দেশটি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ মাত্র ৪ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে নেমে গেছে এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে রুপিরও দ্রুত অবমূল্যায়ন হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে ঋণখেলাপির হওয়ার হাত থেকে সাময়িকভাবে রক্ষা পেয়েছে।

Exit mobile version