নোয়াখালীর একটি বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ও নদী উপকূলীয় এলাকা সুবর্ণচর। সদর থেকে পাকা সড়ক ধরে যেতে সুবর্ণচরের মাঠে মাঠে ধান, সয়াবিন, তরমুজ, মটরশুঁটিসহ নানা শাক-সবজির সবুজে চোখ জুড়িয়ে যায়। পাল বেঁধে চলছে গরু-মহিষ। কিন্তু এসব সৌন্দর্য চাপা পড়ে যাচ্ছে ধর্ষণের অন্ধকার মিছিলে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় জাতীয় গণমাধ্যমেও বারবার শিরোনাম হয় এ উপজেলা। ধর্ষণের সাজায় মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও থামছে না এ জঘন্য কাজ। কিন্তু কেন এ মিছিল লম্বা হচ্ছে সে বিষয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য!
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোটের রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরবাগ্গ্যা গ্রামের এক গৃহবধূকে (৪০) সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় চলতি মাসের ৫ ফেব্রুয়ারি ১০ আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন আদালত। সেই রায় ঘোষণার মাত্র ১২ ঘণ্টার মাথায় অর্থাৎ সোমবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাত ২টায় একই উপজেলার চরওয়াপদা ইউনিয়নের চরকাজী মোখলেছ গ্রামে সিঁদকেটে ঘরে ঢুকে মা-মেয়েকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে তিন দুর্বৃত্ত।
এদের মধ্যে প্রধান আসামি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক মেম্বার আবুল খায়ের মুন্সি (৬৭), হারুন ও তার সহযোগী মো. মেহরাজকে (৪৮) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আসামি মেহেরাজ আদালতে ১৬৪ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অন্যদিকে মুন্সি মেম্বার ও হারুন ৪ দিন করে রিমান্ডে ছিল।
কিন্তু শাস্তি উপেক্ষা করে বারবার ধর্ষণের ঘটনার অনুসন্ধানে ও বিশেষজ্ঞদের মতে বেশ কটি বিষয় উঠে এসেছে। এর মধ্যে ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়াও জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ঘাটতি ও অপরাজনৈতিক বলয়ের আধিপত্য রয়েছে।
ভৌগোলিক অনুষঙ্গ মূলত নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলা একটি বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ও নদী উপকূলীয় এলাকা। ২০০৬ সালে উপজেলা ঘোষণার আগ থেকে এটা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ছিল। ৫৭৬.১৪ বর্গকিলোমিটারের এ উপজেলা ৮ ইউনিয়ন ও ৫৪ গ্রাম নিয়ে গঠিত হয়। উপজেলার জনসংখ্যা ২ লাখ ৮৯ হাজার। এ উপজেলায় শিক্ষার হার ৩২.৮৩ শতাংশ। এরমধ্যে পুরুষ ৩৭.৫০ ও নারীর শিক্ষার ২৮.১৫ শতাংশ।
উপজেলা গঠনের পর এই এলাকায় চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ থেকে চর উড়িয়া, লক্ষ্মীপুরের রামগতি, ভোলার মনপুরা, চরফ্যাশন, জেলার হাতিয়া, কবিরহাট কোম্পানীগঞ্জ থেকে মানুষ এসে জেগে উঠা চরে বসতি স্থাপন করে। বছরে গড়ে কয়েক হাজারের মানুষ এ উপজেলায় আসে। তাদের পারিবারিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি ঐতিহ্য না থাকায় ঘটছে নানান অপকর্ম। একের পর এক এমন ঘটনায় উদ্বিগ্ন সচেতন মহল।
রাজনৈতিক বলয় অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ উপজেলার বেশিরভাগ লোক দেশের বিভিন্ন নদীভাঙা এলাকা থেকে এখনে এসে বসতি গড়ে তুলে। যাদের নিজেদের সাংস্কৃতিক বলয় ও অর্থনৈতিক আশ্রয় নেই। ফলে এ চরে বসতি গড়ার পর রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে দিনের পর দিন বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি দলবদ্ধ ধর্ষণ মামলায় ১০ জনের ফাঁসির রায়ের ১২ ঘণ্টার মধ্যে আবারও দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় আলোচনায় সুবর্ণচর। এসব ঘটনার জন্য জেলা প্রশাসকও পারিবারিক শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কৃতি না থাকাকে দায়ী করছেন।
সংগঠনের পরিসংখ্যান ও সচেতন মহলের মতামত
জেলা নারী অধিকার জোটের তথ্য মতে, ২০২২ ও ২০২৩ সালে সুবর্ণচর উপজেলায় নারী ওপর সহিংসতার ২২টি ঘটনা ঘটেছে। ৫টি হত্যার ঘটনা, বাকি সবই ধর্ষণের ঘটনা।
বারবার ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক আবদুল বারী বাবলু জানান, সুবর্ণচর উপজেলার বেশিরভাগ লোক দেশের বিভিন্ন নদী ভাঙা এলাকা থেকে এসে বসতি গড়ে তুলেছে। গরিব অসহায় এসব পরিবারকে শাসন করছে স্থানীয় প্রভাবশালী একটি মহল। যারা রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে দিনের পর দিন বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে আছে।
নোয়াখালী নারী অধিকার জোটের সদস্য সচিব মনোয়রা মিনু জানান, ‘একটি দলবদ্ধ ধর্ষণের রায়ে ১০ জনের ফাঁসির আদেশ শোনার ১২ ঘণ্টার মধ্যে আবারও দলবদ্ধ ধর্ষণ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে সেটাই দেখিয়ে দেয় যে, সমাজে সঠিক বিচার ব্যবস্থা চালু নেই। সেটা থাকলে নারী ও শিশুদের প্রতি এমন অমানবিক আচরণ হতো না। লাজ-লজ্জার ভয়ে অনেকে মুখ খোলেন না। তবে দু-একটি ঘটনা জানাজানি হলে তা আবার আলোচিত হয় দেশব্যাপী।
সেচ্ছাসেবী সংস্থা নিজেরা করির আঞ্চলিক সমন্বয়ক পরিতোষ দেবনাথ জানান, সবুর্ণ চরের পুরুষরা কাজের সন্ধানে বাইরে থাকে। এ সুযোগটা কাজে লাগায় ধর্ষকরা। অন্যদিকে তারা সকলে রাজনৈতিক ছত্রছায়া থাকায় অপরাধ করতে ভয় পায় না।
সুবর্ণচর সরকারি সৈকত ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আব্দুল্লাহ দিদার এ ক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষার অভাব এবং নৈতিক শিক্ষার অভাবকে দায়ী করেন। এক কথায় বলা যায়, এসব ঘটনার তেমন সুবিচার বিচার হয় না, তাই অপকর্ম বাড়ছে।
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুর রহমান বলেন, ‘পারিবারিক শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে এ জনপদের মানুষদের সচেতন করে তোলা হলে অবরাধপ্রবণতা কমবে।’