প্রতি বছরই আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় নানা কারণে খবরের শিরোনাম হয় মেলার ভেতরে থাকা খাবারের দোকানগুলো। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এসব খবরের শিরোনাম হয়, খাবারের মান ও দাম নিয়ে দর্শনার্থীদের অসন্তোষসহ অন্যান্য নেতিবাচক বিভিন্ন বিষয়। সেই ধারাবাহিকতায় ব্যতিক্রম হচ্ছে না এবারও। খাবারের দাম ও মানের ব্যাপারে আপত্তি প্রকাশ করছেন দর্শনার্থীদের অনেকেই।
খাবারের দাম ও মান এবং ক্ষেত্রবিশেষে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগও রয়েছে এসব খাবারের দোকানের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি মেলায় ‘হাজির বিরিয়ানি’ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ছেন দর্শনার্থীরা। কারণ মেলায় হাজির বিরিয়ানির ছড়াছড়ি!
মেলায় থাকা খাবারের দোকানের প্রায় এক ডজনের মতো নিজেদের ‘হাজির বিরিয়ানি’ দাবি করছেন। এমনকি মেলা প্রাঙ্গণের বাইরে বিআরটিসি (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন) বাস কাউন্টার সংলগ্ন স্থানেও দোকানের নাম দেয়া হয়েছে ‘হাজির বিরিয়ানি’।
এসব ‘হাজির বিরিয়ানি’র আগে পরে অবশ্য অনেকেই যোগ করেছেন, ’অরজিনাল’, ’আসল’ ইত্যাদি নানা বিশেষণ। আর এসব বিষয় দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত হচ্ছেন দর্শনার্থী। বিশেষ করে, এতো এতো হাজির বিরিয়ানির ভিড়ে আসল হাজির বিরিয়ানি কোনটা তা নিয়ে প্রশ্ন অনেকের। পাশাপাশি অনেকের মনে এ প্রশ্নও জাগছে: দেশে এত নাম থাকতে কেন বাণিজ্য মেলায় থাকা এতগুলো খাবারের দোকান নিজেদেরকে হাজির বিরিয়ানি হিসেবে দাবি করছে।
এ ব্যাপারে মিরপুর থেকে আসা দর্শনার্থী স্বপ্না আক্তার জানালেন, ‘মেলায় খাবারের দোকানগুলো যেদিকে সেখানে বেশির ভাগ খাবারের দোকানই নিজেদের হাজির বিরিয়ানি হিসেবে দাবি করছে। আমরা বুঝতে পারছি না, এর কোনটা আসল। ওয়েটারদের জিজ্ঞেস করলে বলছে তাদেরটাই আসল। তাছাড়া পুরান ঢাকার যে হাজির বিরিয়ানি রয়েছে, তার ধারেকাছেও নেই — এসব হাজির বিরিয়ানি নামধারী খাবারের দোকানের বিরিয়ানি।
এ বিষয়ে মেলা কর্তৃপক্ষের নজর দেয়া উচিত বলে জানালেন মোহাম্মদপুর থেকে আসা ফজলুল হক। তিনি বলেন, হাজির বিরিয়ানি নাম দেখে অনেকেই বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তারা ভাবছেন, এ দোকানগুলো হয় তো পুরান ঢাকার হাজির বিরিয়ানির শাখা। কিন্তু খাবার মুখে দিলেই বোঝা যাচ্ছে ফারাকটা।
স্বাদে আসল হাজির বিরিয়ানির সঙ্গে তফাতটা রাতদিন বলে জানালেন তিনি। পাশাপাশি এই হাজির বিরিয়ানি নামধারী দোকানগুলো খাবারের যে দাম নিচ্ছে, সে অনুযায়ী খাবারের পরিমাণ ও মান খুবই নিম্নমানের বলে জানালেন তিনি।
বাণিজ্য মেলার মূল ভবনে অবস্থিত ক্যাফেটেরিয়া থেকে বের হতেই চোখে পড়ে হাজির বিরিয়ানি নামধারী এক খাবারের দোকান। যেখানে চিকেন বিরিয়ানি ২৭৫ টাকা, মাটন কাচ্চি ৩০০ টাকা, বিফ কাচ্চি ২৮০ টাকা এবং স্পেশাল হাজির বিরিয়ানি বিক্রি হচ্ছে ৩৮০ টাকায়।
দোকানের কাউন্টারে থাকা এক ব্যক্তি অবশ্য নাম না প্রকাশের শর্তে কথা বলতে রাজি হলেন। তিনি জানান,
তার দোকানের সঙ্গে পুরান ঢাকার হাজির বিরিয়ানির কোনো সম্পর্কই নেই। এমনকি তাদের অন্য জায়গায় কোনো হোটেল বা রেস্টুরেন্টের ব্যবসাও নেই। প্রতি বছর শুধু বাণিজ্য মেলা উপলক্ষেই তারা এখানে খাবারের দোকান দেন।
দোকানের নাম হাজির বিরিয়ানি কেন — এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি তাদের নিজস্ব হাজির বিরিয়ানি। তাই এ রকম নাম রেখেছেন তারা।
তিনি দাবি করলেন, বাণিজ্য মেলা কর্তৃপক্ষের দেয়া ফুডচার্টের বাইরে খাবারের দামের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কোনো অর্থ রাখছেন না তারা।
এ দোকানে এর সত্যতা পাওয়া গেলেও, খাবারের পরিমাণ ও মান নিয়ে রয়েছে অনেক গ্রাহকেরই আপত্তি। পরিবার নিয়ে খেয়ে ওঠা এক দর্শনার্থী খাবারের মান নিয়ে প্রকাশ করলেন ক্ষোভ। বিশেষ করে, খাবারের পরিমাণ ও মান নিয়ে আপত্তি রয়েছে তার। দাবি করলেন, যে দাম রাখা হয়েছে, খাবারের মান ও পরিমাণ তার থেকে অনেক নিম্নমানের।
এ দোকান থেকে বের হয়ে চোখে পড়লো ‘অরজিনাল হাজির বিরিয়ানি’ লেখা আর একটি দোকানের। ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, যথারীতি এই হাজির দোকানও মৌসুমি দোকান। শুধু বাণিজ্য মেলাতে খাবারের দোকান সাজিয়ে বসেন তারা। পুরান ঢাকার হাজির বিরিয়ানির সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
এসব ‘হাজির বিরিয়ানি’গুলোর খাবারের মানের গুমর ফাঁস হয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের অভিযানেও। শুক্রবার (৯ ফেব্রুয়ারি) খাবারের মান সংক্রান্ত সমস্যার কারণে মেলায় থাকা ‘হাজির বিরিয়ানি অ্যান্ড কাবাব’কে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে সংস্থাটি।
রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র থেকে সরাসরি বিআরটিসি বাসের মাধ্যমে দর্শনার্থীদের জন্য স্বল্প খরচে মেলার প্রবেশ মুখ থেকে পৌঁছানোর ব্যবস্থার পাশাপাশি মেলার অভ্যন্তরীণ পরিবেশ নিয়ে মোটামুটি অন্যান্য বছরের থেকে এবারের মেলা আয়োজনের ব্যবস্থাপনার উন্নতি হয়েছে বলে মনে করছেন দর্শনার্থীরা। তবে অসঙ্গতিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখ আটকাচ্ছে এসব তথাকথিত ‘হাজির বিরিয়ানি’ নামধারী দোকানগুলোতে। এ বিষয়ে মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষকে নজর দেয়া উচিত ছিল বলে মনে করছেন তারা।
গত ২১ জানুয়ারি শুরু হওয়া ২৮তম ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা চলবে আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলছে। ছুটির দিন মেলা চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। এবারের বাণিজ্য মেলার প্রবেশ টিকিট মূল্য গতবারের চেয়ে ১০ টাকা বাড়িয়ে ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর শিশুদের টিকিটের মূল্য ২০ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩০ টাকা।