গেলো তিনটি নির্বাচনে তিন রকম ভূমিকা ছিল বিএনপির। জ্বালাও-পোড়াও, বিতর্ক, নেতৃত্বের সংকট, ভোট ঠেকানোর আন্দোলন — কোনোটাতেই সফলতা পায়নি দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটি।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের বছর দুয়েক আগে থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের মাঠে ছিল বিএনপি। সভা-সমাবেশ এবং হরতালের মতো কর্মসূচি পালন করেছিল দলটি। ২০১৩ সাল থেকে তাদের আন্দোলনে আসে সহিংস রূপ। বিএনপির ডাকা অবরোধের আগুনে পুড়তে থাকে দেশ। নির্বিচার ভাঙচুর চলতে থাকে গণপরিবহনে। ট্রেনে-নবাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে, আগুন জ্বালিয়ে তৈরি করে ভয়ানক ভীতির পরিবেশ। আর এই অরাজক সহিংস আন্দোলনে যুক্ত হয় বিএনপির নির্বাচনি মিত্র জামায়াত শিবির কর্মীরা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর চালাতে থাকে ব্যাপক হামলা। বোমা মেরে পুলিশের হাতের কবজি উড়িয়ে দেয়া, দায়িত্ব পালনকালে প্রকাশ্য রাস্তায় পুলিশকে বেধড়ক পেটানো, সড়ক মহাসড়কের গাছ কেটে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি থেকে শুরু করে নানা রকম সহিংসতা দেখায় তারা। বিএনপি- জামায়াত কর্মীরা এ সময় দেশজুড়ে হত্যা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৯২ সদস্যকে, আর আহত করে বহু মানুষকে। নির্বাচন প্রতিহতের ডাক দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে দেয় ভোট কেন্দ্র। ভোট গ্রহণের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের হত্যা এবং আহত করেন তারা।
এত কিছু করেও শেষ রক্ষা হয়নি। গণতান্ত্রিক ধারা এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখতে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এরপরেও নির্বাচন প্রত্যাখ্যান আন্দোলন অব্যাহত রাখে বিএনপি। চলতে থাকে জ্বালাও- পোড়াও এবং সহিংসতা। এক পর্যায়ে হরতাল অবরোধ থেকে মুখ নিয়ে নেন জনগণ। তীব্র সহিংস আন্দোলনের মুখেও জীবন-জীবিকার তাগিদে মানুষজন বের হয়ে আসে ঘর ছেড়ে। ঘুরতে থাকে গাড়ির চাকা। বাধ্য হয়ে আন্দোলনে ইতি টানে বিএনপি- জামায়াত জোট।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে নতুন ছক নিয়ে মাঠে নামে বিএনপি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জারি রেখেই আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে আসে দলটি। অংশ নেয় রাজনৈতিক সংলাপে। জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট গঠন করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে নির্বাচনে যায় তারা। যুদ্ধাপরাধী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের জন্য ২০টি আসনে নিজেদের প্রতীক ধানের শীষ বরাদ্দ করেন তারা। আবার জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর ক্ষোভে ফেটে পড়েন ড. কামাল হোসেন। ভোটে বিএনপির ফলাফল হয় অত্যন্ত খারাপ।
নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ তোলে বিএনপি। সব প্রার্থীকে ঢাকায় ডেকে অনিয়ম ও কারচুপির তথ্য সংগ্রহের কথা জানায় দলটি। আর এ জন্য সুপ্রিম কোর্টের শহিদ শফিউর রহমান মিলনায়তন ভাড়া করে কয়েক দফায় ৭৯ জন প্রার্থীর বক্তব্য শুনে আর এগোয়নি বিএনপি। সব আসনে অনিয়মের অভিযোগ তুলে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করার ঘোষণা দেন তারা। কিন্তু ৭৪ জন প্রার্থী মামলা করলেও এসবের পরবর্তী কার্যক্রম এগিয়ে নেননি তারা।
এছাড়া সে সময় দলের এক নেতা একাদশ সংসদের এমপিদের শপথ বৈধ হয়নি বলে রিট দায়ের করেন। হাইকোর্ট সেই রিট খারিজ করে দিলে, আপিল বিভাগে যান তারা। আপিলেও একই রায় এলে চুপ হয়ে যান বিএনপির সেই আইনজীবী নেতা।
তবে গেল সাত জানুয়ারির দ্বাদশ নির্বাচনের পর সেই প্রসঙ্গ আবার সামনে এনে গণমাধ্যমে সেই আইনজীবী নেতা বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে অস্পষ্টতা আছে। তার এই মন্তব্য নিয়ে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাকে ভর্ৎসনা করে বলেন, আপিল বিভাগের রায়ের ব্যাখ্যা দেয়ার আপনি কে?
এদিকে, নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন করে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি এখন জমাতে চাইছে নির্বাচন বাতিলের আন্দোলন। যদিও নির্বাচনের আগে ও পরে এবং নির্বাচনের দিন হরতাল অবরোধ করে খুব একটা সাড়া পায়নি দলটি। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এবং যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের না জানিয়ে লন্ডন থেকে অসহযোগ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে বসেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। আচমকা ঘোষণা করা কর্মসূচি মিলিয়ে গেছে বাতাসে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৪ সালে নির্বাচনে অংশ না নিয়ে জ্বালাও- পোড়াও করেছে বিএনপি। ২০১৮ সালে অংশ নিলেও জেতার চেয়ে নির্বাচন বিতর্কিত করাই ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। আর ২০২৪ সালে তত্ত্বাবধায়কের আন্দোলনকে ভোট ঠেকানোর আন্দোলনে রূপ দিয়ে চরমভাবে ব্যর্থ বিএনপি এরপর কী করবে, সেটাই প্রশ্ন?