সাত দিনের সপ্তাহে যদি তিন দিনই ছুটি থাকে তাহলে কেমন হয়? কারো কারো কাছে নিশ্চয়ই এটা বেশ আনন্দের। আবার কারো কারো কাছে এটা নেহায়েতই একটা দিবা স্বপ্ন। সফলদের অনেকেই মনে করেন, জীবনের সুযোগগুলো সব সময় আসে কাজের মোড়কে। এই যেমন মোড়ক খুলে বুঝে নিতে হয় প্রিয় উপহার কিংবা নতুন কেনা পণ্য।
ফলে, কাজ ছাড়া তিন দিন থাকা মানে বড় হওয়ার সুযোগ থেকে দূরে থাকা। আবার অনেকেই মনে করেন, ডে অফ বা ছুটির দিনগুলো মূলত কাজের জন্যে নিজেকে আবারো প্রস্তুত করার জন্যে একটা অন্তবর্তী সময় মাত্র। শুনতে নতুন লাগলেও সত্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সপ্তাহে চার দিন কাজের জন্য বরাদ্দ রাখার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। প্রশ্ন উঠছে তিন দিন ছুটির এই মডেল কী পুরো বিশ্বের জন্যে ফলপ্রসূ হবে?
আগামী ফেব্রুয়ারির শুরুতে ডোমিনিকান প্রজাতন্ত্র প্রথম ক্যারিবিয়ান দেশ হিসেবে চার দিন কাজ ও তিন দিন ছুটির একটি পরীক্ষা চালাবে। বিভিন্ন সংস্থা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই পরীক্ষায় অংশ নেবে এবং এজন্য কর্মীদের কোনো বেতন কাটা হবে না বলে জানিয়েছে আল জাজিরা।
এই ট্রায়াল চলবে ছয় মাস ধরে। সপ্তাহের কর্মঘণ্টা ৪৪ থেকে নামিয়ে ৩৬ ঘণ্টা করা হবে। সপ্তাহ শুরু হবে সোমবার এবং শেষ হবে বৃহস্পতিবার। আশা করা হচ্ছে, জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা সংস্থা, বিদ্যুৎ সংস্থা, একটি লাতিন আমেরিকান টেলিযোগাযোগ সংস্থা এবং একটি ভারী সরঞ্জামের ব্যবসা এই পরীক্ষায় অংশ নেবে। এই পরীক্ষায় দেখা হবে বেশ কয়েকটি বিষয়। কর্মীদের স্বাস্থ্যে কোনো পরিবর্তন এলো কিনা, কাজের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্ক তিন দিনের ছুটিতে কী অবস্থায় দাঁড়ায়, তাও বোঝা হবে।
প্রশ্ন হলো, এই চার দিনের স্বাভাবিক কাজের চাপ কি কমবে? জবাব হলো, না। কাজের চাপ একই থাকবে। বরং কোম্পনির উৎপাদন ও কিছু মিটিং কমতে পারে। দিন কমায় কর্মীদেরকে কাজের অগ্রাধিকার খুঁজে নিতে হবে। সময়ের ভেতরে কাজ শেষ করার তাগিদও তৈরি হতে পারে।
পৃথিবীতে এটাই সপ্তাহে চার দিন কাজ করার প্রথম উদ্যোগ নয়। এর আগে অনেক দেশই এই পরীক্ষা চালিয়েছে। বিশেষ করে কোভিড মহামারি সামাল দিতে অনেক দেশই কাজের সময়ে বেশ ছাড় দিয়েছে। তবে, সপ্তাহে চার দিন কাজের সবচেয়ে বড় পরীক্ষা করেছে যুক্তরাজ্য, ২০২৩ সালে। সেই ট্রায়ালে ৬১ টি কোম্পানি যোগ দেয়, তাদের ৫৬টি ট্রায়ালের মেয়াদ বাড়ায়। ১৮টি কোম্পানি ৪ দিন কাজের মডেলকে নিজেদের নিয়ম হিসেবে গ্রহণ করে।
যুক্তরাজ্যে পরীক্ষায় অংশ নেয়া ২৯০০ চাকরিজীবী জানিয়েছেন, তারা আগের চেয়ে চাপমুক্ত পরিবেশে কাজ করতে পারছেন। জরিপ বলছে, কর্মীদের অর্ধেক, কাজ ও সংসারের দায়িত্বে ভারসাম্য আনতে পেরেছেন। ৪০ শতাংশ কর্মীর রাতের ঘুম গাঢ় হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের জন্যেও কিছু লাভ হয়েছে, এই যেমন সিক লিভ ও নানা ছুতোনাতায় ছুটি নেয়া কমেছে। গিন্নিদের সুবিধা হয়েছে, কর্তারা ঘরের কাজে হাত লাগিয়েছেন।
জাপানে এই মডেল পরীক্ষা করে সুফল পেয়েছে মাইক্রেসফটের মতো কয়েকটি বড় সংস্থা। জাপানে ২০২২ সালে অতিরিক্ত কাজের কারণে ৩ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
চার দিন কাজের মডেল পছন্দ করেছে আইসল্যান্ডও। ২০১৫ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তারাও একটি পরীক্ষা করেছে। এতে দেশটির আড়াই হাজার সরকারি কর্মচারী অংশ নেন। পরীক্ষার ফলাফলে বলা হয়েছে, এতে উৎপাদনশীলতা কমেনি বরং কর্মীদের চাপ কমেছে।
ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে প্রথম বেলজিয়াম সপ্তাহে পাঁচ দিনের পরিবর্তে চার দিন কাজের সুযোগ দিয়ে আইন করে। এতে বেতন কমানো হয়নি। তবে তাদের হিসাব একটু আলাদা। দিনে ৮ ঘণ্টা করে তাদেরকে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টাই কাজ করতে হবে। যদি কেউ চার দিন কাজ করার সুযোগ নেয়, তবে তাকে দিনে ১০ ঘণ্টা করে কাজ করতে হবে।
কাজের দিন নিয়ে কিছু ব্যতিক্রমী উদাহরণও আছে। ২০২১ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ঘোষণা করে, পাবলিক সেক্টরের কর্মীরা সপ্তাহে সাড়ে চার দিন কাজ করবে। বাস্তবতা হলো তারা সপ্তাহে গড়ে ৫২.৬ ঘণ্টা চাকরি করে।
বেশি ছুটি কম কাজই কী এখন দুনিয়ার মানুষের সবার পছন্দ? জবাব হলো, না। উৎপাদন বাড়ানো এবং এর মাধ্যমে দেশের সমৃদ্ধি বাড়াতে সপ্তাহে বেশি দিন বা বেশি সময় কাজ করার চিন্তাও অনেকের আছে। এই যেমন ভারতে সম্প্রতি ৭০ ঘণ্টা কাজ করার আহ্বান, বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
২০২৩ সালে, ভারতীয় বহুজাতিক প্রযুক্তি সংস্থা ইনফোসিসের আইকনিক সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি কাজের সময় বাড়ানোর এই আহ্বান জানিয়েছিলেন। তার যুক্তি ছিলে এতে দেশের অর্থনীতি বড় হবে। জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতের অর্থনীতি এরইমধ্যে সবচেয়ে দ্রুত বড় হচ্ছে।
ভারতীয়রা এখন সপ্তাহে গড়ে ৪৭.৭ ঘণ্টা কাজ করেন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গড় ৩৬.৪ বা জাপানের ৩৬.৬ ঘণ্টার চেয়ে বেশি। এই তথ্য আইএলও এর। এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগতেই পারে আপনি সপ্তাহে কত ঘণ্টা কাজ করার পক্ষে?