পরিবারতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে লুটপাট করাই কাল হয়েছে স্থানীয় সরকার,পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের। যে কারণে তাকে ছুড়ে ফেলে রাজনীতিতে নবীন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ঈগল প্রতীকের ইয়াকুব আলীকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে বেছে নিয়েছেন যশোর-৫ (মণিরামপুর) আসনের ভোটাররা।
সূত্র জানায়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দুবারের সংসদ সদস্য স্বপন ভট্টাচার্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন নতুন প্রার্থী জেলা কৃষক লীগের সহসভাপতি এসএম ইয়াকুব আলী। তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হন। দল দ্বিতীয়বারের মতো স্বপন ভট্টাচার্যকে নৌকা প্রতীক বরাদ্দ দেয়।
স্বপন ভট্টাচার্য স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রথমবার ১০ম জাতীয় নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা টিপু সুলতানকে হারিয়ে। পরবর্তীতে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পান। নির্বাচিত হলে প্রতিমন্ত্রী মনোনীত হন।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও তার ওপরে আস্থা রেখেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু নিজ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন তিনি। এ নির্বাচনে স্বপন ভট্টাচার্য পেয়েছেন ৭২ হাজার ৩৩২ ভোট। আর ইয়াকুব আলী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঈগল প্রতীকে পেয়েছেন ৭৭ হাজার ৪৬৮ ভোট। তিনি ৫ হাজার ১৩৬ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন।
নতুন প্রার্থীর কাছে স্বপন ভট্টাচার্যের পরাজয়ের কারণ হিসেবে স্থানীয় লোকজন ও রাজনীতিকরা নানা বিষয়কে সামনে এনেছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রধান কারণ হিসেবে তারা বলেছেন, গোটা মণিরামপুরকে তিনি ও তার পরিবার লুটপাটের একটি আখড়া বানিয়েছিলেন। প্রতিমন্ত্রীর স্ত্রী তন্দ্রা ভট্টাচার্য, ছেলে সুপ্রিয় ভট্টাচার্য এবং ভাগ্নে উত্তম চক্রবর্তী বাচ্চু- ছিলেন মণিরামপুরের হর্তাকর্তা। দলীয় নেতাকর্মীদের কোনো স্থান ছিল না কোনো কাজেই।
এরাই ছিলেন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সভাপতি; নিয়োগের ক্ষেত্রে বাণিজ্যের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ হতো তাদের মাধ্যমে। স্বপন ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে সবচেয়ে জোরালো যে অভিযোগ, তা হচ্ছে মণিরামপুরে জামায়াত-বিএনপিকে প্রশ্রয় দেয়া, তাদের লালন-পালন। এ ছাড়া এই অঞ্চলের মানুষের সবচেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে ভবদহ। সেই ভবদহের টিআরএম প্রকল্প যাতে অনুমোদন না হয়, সেই ব্যবস্থা করে স্থানীয় মানুষদের স্বার্থবিরোধী সেচ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে টেন্ডারবাজি করে কোটি কোটি টাকা উপার্জন। যেটি নিয়ন্ত্রণ করতেন তার ছেলে।
স্থানীয়রা বলেন, যে কারণে টিপু সুলতানকে হারিয়ে লোকজন স্বপন ভট্টাচার্যকে জিতিয়েছিলেন, বিজয়ের পর থেকেই তিনিও সেই পথে হাঁটেন। তিনি স্থানীয় লোকজনের সেন্টিমেন্টকে থোড়াই কেয়ার করেছেন।
বিগত পাঁচ বছর ধরে এমন অসহনীয় পরিবেশের মধ্যে স্থানীয়রা নতুন একজনকে মনে মনে খুঁজছিলেন। ঠিক সুযোগটা কাজে লাগিয়েছেন এসএম ইয়াকুব আলী। তিনি এই সময়কালে গোটা মণিরামপুরে নিজের টাকায় দান-ধ্যান করে পরিচিতি লাভ করেন। মূলত তিনি একজন ব্যবসায়ী। হালে এসে রাজনীতিক হয়েছেন।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, বিশেষ করে এই আসনের সর্বাধিক ৫ বারের সংসদ সদস্য প্রভাবশালী রাজনীতিক টিপু সুলতানের অনুসারীদের একটা বড় অংশ এস এম ইয়াকুব আলীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন। তৃণমূল পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীরা তাকে বিশ্বাস করেছেন। সেই বিশ্বাসের জায়গা থেকেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে তাকে বিজয়ী হতে সহায়তা করেছে।
স্বপন ভট্টাচার্যের পরাজয়ের কারণ উল্লেখ করতে গিয়ে হরিহর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি মোস্তফা কামাল বলেন, সীমাহীন দুর্নীতি, নামমাত্র কাজ করে ভবদহের কয়েকশ কোটি টাকা লুটপাট, দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে বিএনপি-জামায়াতের লোকজন বিশেষ করে নাশকতা মামলার আসামিদের চাকরি প্রদান, দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বিশেষ করে তৃণমূলের নেতাকর্মীকে সঙ্গে সম্পর্কহীনতা এবং নিজের স্ত্রী, ছেলে আর ভাগ্নের একটা বলয় তৈরি করে একটি সিন্ডিকেট বানিয়েছিলেন তিনি। যার খেসারত দিতে হয়েছে স্বপন ভট্টাচার্যকে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন বলেন, স্বপন ভট্টাচার্য মণিরামপুরে যে উন্নয়নের কাজ করেছেন বলে বেড়ান, তা রাষ্ট্রের উন্নয়নের গতানুগতিক কাজ। আসলে মণিরামপুরবাসী পরিবর্তন চেয়েছিলেন। মানুষের ঘের দখল, টেন্ডারবাজি, সংখ্যালঘু নির্যাতন, ভাগ্নের চাল চুরি, নিয়োগ বাণিজ্যের মাধ্যমে দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছিলেন তিনি। এ কারণে ভোটাররা তাদের রায় ভোটে দিয়েছেন।
স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াকুব আলীর প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক জিএম আব্দুল মজিদ বলেন, বিগত দিনে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা প্রতিমন্ত্রীর কাছ থেকে অত্যাচারিত হয়েছেন, অবহেলার শিকার হয়েছেন। ইয়াকুব সাহেব একজন ভালো মানুষ, দানবীর। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এইবার ঈগলে ভোট দিয়ে প্রতিমন্ত্রীর ওপর বদলা নিয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত, মণিরামপুর পৌরসভার মেয়র উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কাজী মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
পরাজয়ের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, নামধারী কিছু দলীয় নেতা এবার নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছেন। তারা নৌকায় ভোট দেননি। সাংগঠনিকভাবে স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ভোট করার বিষয়ে কোনো বাধা ছিল না। তা ছাড়া, ভোটের দিন বিএনপি-জামায়াতের লোকজনও ভোট দিয়েছেন।
প্রতিমন্ত্রী তার স্ত্রী, ছেলে, ভাগ্নে নিয়ে একটি বলয় তৈরি করে নিয়োগ-বাণিজ্য করেছেন, দলের লোকজনকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো মোটেও সত্য নয়।